শনিবার, ৭ মার্চ, ২০১৫

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা

মুফতী মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
কুরআন, সুন্নাহ এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সংঘটিত ইজমা ও কিয়াস-এ চারটি মূলনীতি হচ্ছে দীন ও শরীআতের যাবতীয় বিধি বিধানের মাপকাঠি। কিন্তু কুরআন সুন্নাহতে বর্ণিত আহকামসমূহের প্রত্যেকটি সমান নয়। কিছু কিছু আহকাম হচ্ছে স্পষ্ট ও বিরোধমুক্ত। যেমন নামায ফরয হওয়া, রোযা ফরয হওয়া, হজ্জ ফরয হওয়া, যিনা নিষিদ্ধ হওয়া, মদ খাওয়া ও চুরি করা নিষিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। এগুলোর উপর আমলের জন্য কোন প্রকার চিন্তা গবেষণার প্রয়োজন নেই।
পক্ষান্তরে কিছু কিছু আহকাম হচ্ছে এমন যে, এগুলো সম্পর্কে বর্ণিত আয়াত বা হাদীস অস্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত বা আপাত:দৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ। যেমন- আল্লাহ তা’আলার বাণী: وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ আলোচ্য আয়াতে قُرُوءٍ শব্দটি দুইটি অর্থে মুশতারাক। একটি হলো حيض (ঋতুস্রাব), অপরটি হলো طهر (পবিত্রতা)। সুতরাং এখানে শব্দটি কোন অর্থে গৃহীত হবে সে বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন আছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস:
مَنْ لم يترك المخابرة فليأذَن بِحَرب من الله ورسوله. (جامع الأصول في أحاديث الرسول)
অর্থাৎ যে মুখাবারা বা বর্গা ব্যবস্থা পরিহার করে না সে যেন আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধে নামার ঝুঁকি নেয়।
এ হাদীস থেকে আমভাবে বর্গা প্রথা নিষিদ্ধ বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু সকল বর্গাই নিষিদ্ধ নাকি এর বিশেষ কোন প্রকার নিষিদ্ধ তা এখানে সুস্পষ্ট নয়।
অন্য হাদীসে আছে-  مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ . (إتحاف الخيرة المهرة) অর্থাৎ যে ইমামের পেছনে নামায পড়বে, ইমামের কিরাত তার জন্য যথেষ্ট হবে। অপরদিকে অন্য হাদীসে এসেছে-
لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ. (إتحاف الخيرة المهرة)
অর্থাৎ যে সূরা ফাতিহা পড়েনি তার নামায শুদ্ধ হয়নি।
আলোচ্য হাদীসদ্বয় আপাতদৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ হওয়ায় কোন হাদীসের উপর আমল করা যাবে তা স্পষ্ট নয় এবং স্বাভাবিক ইলম দ্বারা তা বুঝাও সম্ভব নয়।
এ ধরণের জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে আমলের জন্য দুটি পথ। প্রথমত: নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করে ফয়সালা করা। দ্বিতীয়ত: এ ব্যাপারে পূর্বসূরীগণের প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের আলোকে আমল করা। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পথই সাধারণ মানুষ ও অমুজতাহিদ আলিমের জন্য অপরিহার্য। তা না হলে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর এরূপ মাসআলায় নির্দ্বিধায় কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করার নামই হচ্ছে তাকলীদ।
জটিল মাসআলায় সাধারণ লোকদের তাকলীদ ছাড়া কোন পথই নেই। তাদেরকে পূর্বসূরী প্রজ্ঞাশীল কোন মুজতাহিদকে অনুসরণ করতেই হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এরূপ তাকলীদের সরাসরি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কুরআন মজীদে তাকলীদের দলীল
১। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ .
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলুল আমর এর আনুগত্য কর। (সূরা নিসা- ৫৯)
উক্ত আয়াতেأُولِي الْأَمْرِ  বলতে কারা- এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কিরাম প্রায় সকলেই বলেছেন, এরা হলেন কুরআন সুন্নাহ’র ইলমের অধিকারী ফকীহ ও মুজতাহিদগণ।
২। পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে আছে-
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ .
অর্থাৎ যখন তাদের কাছে শান্তি অথবা ভীতি সংক্রান্ত কোন সংবাদ আসে, তখন তারা তা প্রচারে লেগে যায়। অথচ যদি (তারা তা না করে) বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর এর কাছে ছেড়ে দিত, তাহলে ইস্তিম্বাতে পারদর্শী তথা সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারীগণ এর রহস্য উদঘাটন করতে পারতেন। (সূরা নিসা- ৮৩)
উক্ত আয়াত যুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হলেও একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, পবিত্র কুরআনের কোন আয়াতের শানে নুযুল খাস হলেও এর উপর আমল আম। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন জটিল বিষয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে বিজ্ঞ লোকদের প্রজ্ঞাশীল সিদ্ধান্তের অনুসরণ ও তাকলীদ করা আবশ্যক।
৩। অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
Ñপ্রত্যেক দল থেকে এক একটি ছোট দল ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন বেরিয়ে পড়ে না, যাতে তারা যখন তাদের কওমের কাছে ফিরে আসবে তখন তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করবে, যেন তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবাহ- ১২২)
উক্ত আয়াতে ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য একদল লোককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর কওমের বাকী লোক যারা এ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভ করতে পারেনি তাদেরকে ঐ ফকীহদের আনুগত্য বা তাকলীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৪। আল্লাহ তাআলার বাণী- فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ অর্থাৎ তোমরা যদি না জান তাহলে আহলে ইলমদের কাছ থেকে জেনে নাও। (সূরা নহল- ৪৩, আম্বিয়া- ০৭)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ সকলকে কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি ফতওয়া বের করার নির্দেশ না দিয়ে বরং কুরআন হাদীসের ইলমে পারদর্শী লোকদের কাছ থেকে অজ্ঞ লোকদের জেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাকলীদের মূল কথাও হলো তাই।

হাদীস শরীফ থেকে তাকলীদের দলীল
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদীস থেকে অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞ আলিমের কাছে ফতওয়া তলব ও তদনুযায়ী আমল করার নির্দেশ ও প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
০১। হাদীস শরীফে আছে-
عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جُلُوسًا فَقَالَ إِنِّي لَا أَدْرِي مَا قَدْرُ بَقَائِي فِيكُمْ فَاقْتَدُوا بِالَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي وَأَشَارَ إِلَى أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ.
-হযরত হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- জানি না আমি আর কতদিন তোমাদের মধ্যে থাকব। সুতরাং তোমরা আমার পরবর্তীদের অনুসরণ করবে। একথা বলে তিনি আবূ বকর ও উমর (রা.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে ইমাম আহমদ)
উক্ত হাদীসে ‘ইকতিদা’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যার অর্থ শরীআতের বিষয়সমূহে কেউ কারো অনুসরণ করা।
০২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أُفْتِىَ بِغَيْرِ عِلْمٍ كَانَ إِثْمُهُ عَلَى مَنْ أَفْتَاهُ.
অর্থাৎ যে না জেনে ফতওয়া প্রদান করবে, এর পাপ ফতওয়াদাতার উপরই পতিত হবে।
লক্ষ্যণীয় যে, এখানে ফতওয়ার দায়-দায়িত্ব ফতওয়াদাতার উপর চাপানো হয়েছে। কিন্তু তার ফতওয়া অনুযায়ী যারা আমল করেছেন তাদেরকে দোষারোপ করা হয়নি। আবার অনুসরণকারীদেরকে যাচাই বাছাই করে ফতওয়া গ্রহণের নির্দেশও দেয়া হয়নি। এরূপ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফতওয়াদাতা ও আমলকারী উভয়কে সমানভাবে দোষারোপ করতেন। এতে বুঝা যায় একদল লোক কেবল তাকলীদ করবেন এবং তাদের তাকলীদ করা শুদ্ধ হবে।
০৩। কোন কোন সাহাবী নামাযের জামাতে দেরিতে এসে পেছনে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে প্রথমে এসে প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর তাকীদ দিয়ে ইরশাদ করেন-
ائْتَمُّوا بِي وَلْيَأْتَمَّ بِكُمْ مَنْ بَعْدَكُمْ
অর্থাৎ তোমরা আমার অনুসরণ কর আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদের অনুসরণ করবে।
[সূত্র : মুফতী মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী কৃত ‘তাকলীদের সুদৃঢ় রজ্জু’]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন