বুধবার, ১১ জুন, ২০১৪

ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ

মুফতি শামসুর রহমান পোরশা

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এর মধ্যে মানবজাতির যাবতীয় কল্যাণ নিহিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত এদুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখবে। একটি হলো, আল্লাহর কালাম কোরআন মাজিদ, অপরটি হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অমূল্য বাণী হাদিস শরীফ। মানব জীবনে সফলকাম হতে হলে, কোরআন-হাদিসে যে সকল বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গ রূপে বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয়ে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে, তা পরিহার করা অতীব জরুরি।
কোরআন-হাদিসে যে সকল বিষয়াবলীর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম একটি হলো, ‘রিবা’ বা সুদ। সুদ শব্দটি আরবি শব্দ ‘রিবা’ থেকে নির্গত। এর অর্থ- অতিরিক্ত, বেশি বা পরিবৃদ্ধি। শরিয়তের পরিভাষায় ‘রিবা’ বা সুদ ঐ অতিরিক্ত সম্পদকে বলা হয়, যা কোনো প্রকার বিনিময় ব্যতীতই অর্জিত হয়। (হিদায়া, হাশিয়া- ৩/৭৭)। এতে ঐ অতিরিক্ত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত, যা ঋণ দিয়ে নেয়া হয়। কেননা ঋণের মধ্যে মূলধন ঠিকই থাকে। আর অতিরিক্ত সম্পদকে কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়াই নেয়া হয়। অনুরূপ বাণিজ্যিক ঔ সকল লেন-দেনও অন্তর্ভূক্ত যা কোনো প্রকার বিনিময় ব্যতীতই অতিরিক্ত হিসাবে নেয়া হয়ে থাকে।
পবিত্র কোরআনে-হাদিসে পরিষ্কার ভাষায় সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সাথে সাথে এর পরিণাম যে ভয়াবহ তাও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বর্ণণা করা হয়েছে। যেমন- অষ্টম হিজরীতে সূরা বাকারার ২৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ পাক সুদকে হারাম ঘোষণা করে বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কবর থেকে কিয়ামত দিবসে দ-ায়মান হবে, যেভাবে দ-ায়মান হয় ঔ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আছর করে মতিচ্ছন্ন করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয়-সুদ নেয়ারই মতো। অথচ আল্লাহপাক ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং যে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তাদের জন্যে জাহান্নাম অবধারিত। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।’ (সূরা বাকারা- ২৭৫)
ইসলামের পূর্বে বর্বরতার যুগে আরবরা সুদকে ক্রয়-বিক্রয়ের মতো মনে করতেন। কারণ তারা মনে করতেন, বেচা-কেনা এবং সুদ উভয়ের মধ্যে লভ্যাংশ উদ্দেশ্য। সুতরাং বেচা-কেনা যেমন হালাল তেমনিভাবে সুদকেই হালাল মনে করতেন। উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহপাক তাদের ধারণকে ভুল সাব্যস্ত করে বলেন, ব্যবসা এবং সুদ এক নয়। এ দুটির মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। তাই সুদকে ব্যবসার মতো মনে করে উভয়কে বৈধ বলা শরীয়ত পরিপন্থী।
তাছাড়া তাদের দাবি যদি মেনে নেয়া হয়, তারপরও সুদ হারাম হওয়ার জন্য এতো টুকু যথেষ্ট যে, এ ভূম-ল ও নভোম-লের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাক ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন। যখন সকল জিনিসের ক্ষমতাধর মহান আল্লাহপাক কোনো বস্তুকে হারাম করেন। তখন এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ থাকে না।
তাছাড়া ব্যবসা এবং সুদ এ দুটিকে এক বা অভিন্ন মনে করা নিতান্ত ভ্রান্তি। কারণ বেচা-কেনা এবং ব্যবসার আসল উদ্দেশ্যর প্রতি লক্ষ্য করলে, ব্যবসা ও সুদের মধ্যে যে অনেক পার্থক্য রয়েছে, তা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যর মধ্যে যে লভ্যাংশ বা অতিরিক্ত সম্পদ অর্জিত হয়, তা পণ্যের বিনিময়ে, আর সুদের মধ্যে পণ্য ব্যতীতই অতিরিক্ত সম্পদ অর্জিত হয়।
তাছাড়া বেচা-কেনা বৈধ হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলো, উভয় পক্ষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তি সম্মতি থাকা। কিন্তু তা সুদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে না। তাই ব্যবসা এবং সুদকে এক মনে করে সুদকেই বৈধ বলা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। এছাড়া কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে সুদের ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে, যেমন- আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গ্রহণ করো না। এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তাতে তোমরা সফলকাম হবে।’ (আল-ইমরান- ১৩০)
সুদকে হারাম ঘোষণা করার সাথে সাথে সুদের বকেয়া অর্থ সর্ম্পকেও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও।’ (সূরা-বাকারা- ২৭৮-২৭৯ )। এ আয়াতে সুদখোরদের কঠিন ধমকি শুনানো হয়েছে, এমন কঠিন ধমকি কুফরী ব্যতীত বড় অপরাধের কারণেও কোনো পাপিষ্ঠদের ওপর কোরআন-হাদিসে আসেনি। এর দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সুদের গুনাহ অত্যন্ত মারাত্মক।
অন্যত্রে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, আমি ইহুদিদের জন্য হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্তু, যা তাদের জন্য হালাল ছিলো। তাদের সীমালংঘনের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক বাধা প্রদানের দরুণ। তার কারণ, তারা সুদ গ্রহণ করতো। অথচ এই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছিলো। (সূরা-নিসা-১৬০-১৬১)। উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সুদ এতোই নিকৃষ্ট যে, তার কারণে হালাল বস্তু পর্যন্ত হারাম করা হয়েছে। ইমাম কুরতুবী (রহ.) উল্লেখ করেন, সুদ এমন নিকৃষ্ট হারাম যা প্রত্যেক শরীয়তে হারাম ছিলো। যেমন- আল্লাহপাক ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বলেন, ইহুদিরা সুদ খায়, অথচ তাওরাতে তাদের জন্য সুদকে হারাম করা হয়েছিলো। (তাফসীরে কোরতুবী-৩/৩৬৬)। অন্রুূপভাবে অন্যান্য আসমানী কিতাবসূমহে সুদের ওপর নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছিলো। যে বস্তুকে প্রত্যেক শরীয়তে হারাম করা হয়েছে, তা কি পরিমাণ অপছন্দনীয় ও জঘন্য হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
সুদ হারাম হওয়া সর্ম্পকে এ হাদিসটিই ছিলো সর্বশেষ ঘোষণা। হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) উল্লেখ করেন, সুদ হারাম হওয়ার বিধানটি ইসলামের বিধান সূমহের মধ্যে সর্বশেষ বিধান। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের লিখক এবং সুদী লেন-দেনের সাক্ষী দ্বয়ের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, তারা গুনাহের ব্যাপারে সকলেই সমান অপরাধী।’ (মুসলিম শরীফ- ২/২৭)। অন্যত্রে হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সুদের মধ্যে সত্তর প্রকার গুনাহ বিদ্যমান রয়েছে। এর সবচেয়ে নিম্নস্তরের গুনাহটি হলো, নিজের মায়ের সাথে যিনা করার সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ পৃ- ১৬৪)
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদ খাওয়াকে কবিরা গুনাহের অন্তভুর্ক্ত করে বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বাংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! সে সাতটি জিনিস কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, এক. আল্লাহ তা‘আল্লার সাথে কাউকে অংশীদার করা। দুই. যাদু বিদ্যা অর্জন করা। তিন. অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করা। চার. সুদ ভক্ষণ করা। পঞ্চম. ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা। ছয়. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা। সাত. কোনো নিরঅপরাধী নারীকে অপবাদ দেয়া।’ (মুসলিম শরীফ-১/৬৪)। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহপাক চার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না এবং তাদেরকে জান্নাতের নিয়ামত সমূহ থেকে বঞ্চিত করবেন। তারা হলেন, এক. মদপান কারী। দুই. সুদ ভক্ষণ কারী। তিন. অন্যায় ভাবে ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারী। চার. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।’ (হাকিম) তাছাড়া সুদের একটি কুবৈশিষ্ট্য রয়েছে। যে ব্যক্তি সুদী লেন-দেনে অভ্যস্ত, সম্পদের লোভ-লালসা তাকে এমন বিবেকহীন ও উদাসীন করে যে, সারাক্ষণ কিভাবে সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, সে চিন্তায় মগ্ন থাকে। অথচ সুদের মাধ্যমে যে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাতে বরকত থাকে না। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুদের মাধ্যমে সম্পদ বাড়ায়, তার সম্পদে অবশ্যই ঘাটতি দেখা দিবে।’ (ইবনে মাজাহ পৃ- ১৬৫) বর্তমান যুগে সুদ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কোরআন-হাদিসের এর নিষেধাজ্ঞা ও এর ভয়াবহ শাস্তির দিকে অনেকেই কর্ণপাত করছেন না। অনেকেই আবার সুদকে অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ মনে করছেন এবং আবার অনেকেই সুদকে দারিদ্র্যতা বিমোচনের অন্যতম পন্থা হিসাবে আখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, সুদ কখনো কোনো গরিবের দারিদ্র্যতা বিমোচন করতে সক্ষম হয়নি, বরং সুদ গরীবকে আরো গরীব এবং ধনীকে আরো ধনী বানিয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে কিছু কিছু ব্যক্তি সুদের সাময়িক উপকার দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। অথচ সুদের জাগতিক ও পারলৌকিকের ভয়াভয় পরিণাম এ উপকারের তুলনায় যে অত্যন্ত জঘন্য, সে দিকে লক্ষ্য রাখেন না। আল্লাহপাক সকলকে সুদের ভয়াবহতা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

শবে বরাত বিতর্ক


Posted by Shawon Muhammad Shahriar

বছর পাচেক আগের কথা। চাকরির সুবাদে তখন আমি খুলনাতে থাকতাম। একই ফ্ল্যাটে আমার সঙ্গে থাকতেন আমারই বয়সী আরো দুইজন ভদ্রলোক। সেদিন ছিল শবে বরাতের রাত। মসজিদের লাউড স্পিকারগুলো থেকে ভেসে আসছে ওয়াজ, যিকর আর দুআর আওয়াজ। আশে-পাশের বাসা থেকে ভেসে আসছে মুখে জল আনা সব খাবারের গন্ধ। বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ গেছেন মসজিদে। মহিলারা ব্যস্ত খাবার তৈরি আর পরিবেশনে, একটু পরে তারাও শুরু করবেন নফল ইবাদাত।

রাত সাড়ে নয়টা বাজতে তখন কয়েক মিনিট বাকী। আমার এক ফ্ল্যাটমেটকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন শবে বরাত বলে আদৌ কিছু আছে কি না। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বক্তাদের বিপরীতধর্মী কথাবার্তায় অন্যদের মতো উনিও খানিকটা কনফিউসড। আমি খুব কনফিডেন্স নিয়ে তাকে বলে দিলাম যে শবে বরাত বলে আসলে কিছু নেই, তাই এই রাতের বিশেষ কোন তাৎপর্যও নেই।

সর্বনাশ! যেই না বলা অমনি উনি সনি এন্টারটেইনমেন্ট টিভিতে টিউন করলেন। একটু পরেই যে শুরু হবে সুপার হিট শো ইন্ডিয়ান আইডল। পরবর্তী ঘন্টাখানাকের জন্য আমার ফ্ল্যাটমেট ডুবে গেলেন হিন্দি গানের জগতে। তখন নিজেকে কিছুটা হলেও দোষী মনে হতে লাগল। যদি আমি তাকে বলতাম যে শবে বরাত একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাত তবে হয়ত উনি কিছু ইবাদাত-বন্দেগি করতেন, হয়ত উনি ওই রাতে ইন্ডিয়ান আইডল দেখতেন না। হোক এক রাতের জন্য, তবুও তো আল্লাহকে কিছুটা স্মরণ করতেন!

ওই সময়ে আমি একটি বিশেষ দেশের উলামা এবং তাদের অনুসারীদের লেখা বেশি পড়তাম এবং তাদের মতকেই একমাত্র “সঠিক ইসলাম” বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম। বিতর্ক এড়ানোর জন্য সঙ্গত কারণেই দেশটির নাম উল্লেখ করছি না।

পরবর্তীতে অন্যান্য দেশের উলামা এবং তাদের অনুসারীদের লেখার সঙ্গেও ধীরে ধীরে পরিচিত হতে শুরু করলাম। যতই পড়তে থাকলাম ততই আবিষ্কার করতে থাকলাম যে “সঠিক ইসলাম” বিশেষ কোন দেশের উলামাদের একক সম্পত্তি নয়। একই বিষয়ে একাধিক মতামত থাকতে পারে, আর মজার বিষয় হল এগুলোর কোনটিই ভুল নাও হতে পারে। ফলে উলামাদের কোন মতকেই সরাসরি ভুল বলে উড়িয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না।

শবে বরাত এমন একটি বিষয় যা নিয়ে অনেক আগে থেকেই উলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। এখানে ইচ্ছা করেই আমি শবে বরাত সংশ্লিষ্ট হাদিসসমূহের বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করছি না, কারণ না আমি নিজে, না এই লেখার পাঠকরা উসুল আল-হাদিস এবং রিজালশাস্ত্র নিয়ে তেমন কোন বিশেষ জ্ঞান রাখেন। জৈব রসায়নের কোন বিশেষ সূত্র নিয়ে আলোচনার সঠিক জায়গা যেমন এটি নয়, তেমনি কোন বিশেষ হাদিসের বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা নিয়ে সমালোচনামূলক বিস্তারিত আলোচনার সঠিক জায়গাও এটি নয়। সাধারণ মানুষ হিসেবে তাই এই বিষয়ে উলামাদের মত জানাটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

যেসব বিখ্যাত উলামা শবে বরাতের বিশেষ তাৎপর্যের পক্ষে মত দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ইমাম আওযায়ী, ইমাম ইবন তায়মিয়্যা, ইমাম ইবন রজব এবং তৎকালীন শামদেশীয় অধিকাংশ উলামা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম)। অন্যদিকে ইমাম আতা বিন আবি রাবাহ, ইবন আবি মুলাইকা, ইমাম মালিকের ছাত্রগণ এবং তৎকালীন হিজাজের অধিকাংশ উলামাদের (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম) মতে শবে বরাতের বিশেষ কোন তাৎপর্য নেই, বরং এই রাতটি অন্যান্য রাতগুলোর মতোই।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, শবে বরাত বিষয়টি সাদা-কালো বা দিন-রাতের মতো কোন স্পষ্ট বিষয় নয়, বরং এটি এমন একটি বিষয় যেটি নিয়ে যুগের পর যুগ ঘরে মতপার্থক্য চলে আসছে। তাই আপনি শবে বরাত পালন করুন বা না করুন, অন্ততপক্ষে আপনার বিপরীত মতের অনুসারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এটিই কাম্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ধর্মীয় বিবাদপূর্ণ বিষয়সমূহে আমাদের আরো সহনশীল হওয়ার তৌফিক দিন এই কামনা করি।

http://hridoyeislamdotcom.wordpress.com/2012/07/05/shab-e-barat-debate/#

মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০১৪

শবে বরাত : করণীয় ও বর্জনীয়


মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

আরবী চান্দ্র বর্ষের অষ্টম মাস শা’বান-এর মধ্যবর্তী রাত তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ‘শবে বরাত’ হিসেবে পরিচিত। শবে বরাত শব্দযুগল ফার্সী। এর আরবী পরিভাষা ‘লাইলাতুল বারাআত’। ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ রাত আর ‘বারাআত’ শব্দের অর্থ মুক্তি। অতএব লাইলাতুল বারাআত শব্দের অর্থ মুক্তির রজনী। বিভিন্ন তাফসীরগ্রন্থে এ রাত বুঝাতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ শব্দযুগল ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীসে নববীতে এ রাতের ক্ষেত্রে “লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান” পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ রাতের বিভিন্ন নাম রয়েছে। তাফসীরে কাশশাফে এ রাতের চারটি নামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন : আল লাইলাতুল মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআহ, লাইলাতুস সাক ও লাইলাতুর রাহমাহ। তাফসীরে কাশশাফে এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত নামে নামকরণ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, কর আদায়কারী যখন কর আদায় করে তখন করদাতাদের জন্য মুক্তিনামা লিখে দেয়। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ এ রাতে তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য মুক্তিনামা লিখে দেন। (তাফসীরে কাশশাফ, খ- ৪, পৃষ্ঠা ১৭২)
হযরত ইকরামা (রা.) বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) লাইলাতুল কদরকে লাইলাতুত তা’যীম, শা’বানের মধ্যবর্তী রাতকে লাইলাতুল বারাআত ও দুই ঈদের রাতকে লাইলাতুল জায়িযাহ নামে নামকরণ করতেন। (তাফসীরে মাওয়ারদী, খ- ৬, পৃষ্ঠা ৩১৩)

শবে বরাতের ফযীলত
শবে বরাত এক মহিমান্বিত রজনী। এ রজনীতে দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপন বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া সকল মুমিন বান্দাকে ক্ষমার দানে অনুগৃহীত করেন।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক অথবা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান (অখ-) পৃষ্ঠা ১৫১৪, হাদীস নং ৫৬৬৫)
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণিত হাদীসটির সনদের প্রত্যেক বর্ণনাকারী  অত্যন্ত বিশ্বস্থ ও নির্ভরযোগ্য। হাফিয নূরুদ্দীন আল হায়সামী বলেন, উক্ত হাদীসটি ইমাম তাবারানী (র.) তদীয় আল মুজামুল কাবীর ও আল মুজামুল আওসাত-এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এ দু’গ্রন্থের সকল রাবী সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য। (মাজমাউয যাওয়াইদ, খ- ৮, পৃষ্ঠা ১২৬)
শায়খ নাসিরউদ্দিন আলবানী তদীয় ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা’ গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করত  এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন- এ হাদীসটি সহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে, যা একে অন্যকে শক্তিশালী করে। এ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কিরাম হলেন- ১. হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) ২. আবূ সা’লাবা আল খুশানী (রা.) ৩. আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ৪. আবূ মূসা আল আশআরী (রা.) ৫. আবূ হুরায়রাহ (রা.) ৬. আবূ বকর (রা.) ৭. আউফ ইবনে মালিক (রা.) ৮. হযরত আয়িশাহ (রা.)। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা, খ- ৩, পৃষ্ঠা ১৩৫, হাদীস নং ১১৪৪)
হাদীস শরীফে আছে, এ রাতে আল্লাহর তরফ থেকে ঘোষণা আসে : কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিয্্ক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিয্্ক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্থ আছো কি? আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্ত করব। এমনি ঘোষণা সারা রাত চলতে থাকে।
মুমিন বান্দাগণ এ ঘোষণার আলোকে আপন চাহিদা অনুযায়ী আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনানুযায়ী এ রাতে সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত হয়। আর শবে কদরে তা দায়িত্বশীল ফেরেশতার নিকট সোপর্দ করা হয়।
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতে মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করা হয় (অর্থাৎ জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তরিত করা হয়)। এমনকি একজন মানুষ মুসাফির হিসেবে বের হয় (সফরে বের হয়) অথচ তার নাম (ইতোমধ্যে) জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের মধ্যে নিয়ে রাখা হয়ে গেছে। এমনিভাবে একজন মানুষ বিয়ে করে অথচ তার নাম (ইতোমধ্যে) জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের মধ্যে নিয়ে রাখা হয়ে গেছে। (ইমাম আবদুর রায্্যাক আস সান‘আনী, মুসান্নাফ, খ- ০৪, পৃষ্ঠা ৩১৭)
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং আপন বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, যে আমার কাছে দু‘আ করবে আমি তার দু‘আ কবূল করব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব, যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। বুখারী শরীফে আছে- হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাতে, যখন রাতের শেষ এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে তখন দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, যে আমার কাছে দু‘আ করবে আমি তার দু‘আ কবূল করব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব, যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব (বুখারী, হাদীস নং ১১৭৫)। কিন্তু শবে বরাতের ক্ষেত্রে শেষ এক তৃতীয়াংশ নয় বরং রাতের শুরুতেই মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং আপন সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিয্্ক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিয্্ক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্থ আছো কি? আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্ত করব। এমন ঘোষণা সারা রাত চলতে থাকে।
শবে বরাত দু‘আ কবূলের অন্যতম রাত। এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাহর দু‘আ কবূল করেন। ইমাম আবদুর রায্্যাক আস সান‘আনী (র.) তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে ইবনে ওমর (রা.)-এর একটি বর্ণনা স্বীয় সনদে উল্লেখ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন- পাঁচ রাতে দু‘আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না (অর্থাৎ দু‘আ কবূল হয়ে থাকে)। এ পাঁচ রাত হলো- জুম‘আর রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত ও দুই ঈদের রাত। (মুসান্নাফে আবদুর রায্্যাক, খ- ০৪, পৃষ্ঠা ৩১৭)

শবে বরাতে আমাদের করণীয়
বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার সফরনামা ‘রিহলাতু ইবনে বতুতা’-এর মধ্যে ‘শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে তাদের (মক্কাবাসীদের) রীতি’ শিরোনামের অনুচ্ছেদে আছে, মক্কাবাসীদের নিকট এ রাত (শবে বরাত) মর্যাদাবান রাতসমূহের অন্তর্ভূক্ত। এ রাতে তারা তাওয়াফ, জামাআতে ও একাকী নামায আদায়, ওমরা ইত্যাদি নেক আমলের প্রতি মনোনিবেশ করতেন এবং মসজিদে হারামে দলবদ্ধভাবে জমায়েত হতেন। প্রত্যেক দলের একজন ইমাম থাকতেন। ... তারা একশত রাকাআত নামায পড়তেন। যার প্রত্যেক রাকাআতে সূরা ফাতিহা ও দশবার করে সূরা এখলাস পড়তেন। কেউ কেউ হিজ্্র-এ একাকী নামায পড়তেন। আবার কেউ বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করতেন এবং কেউ কেউ ওমরার উদ্দেশ্যে বের হতেন।
লাতায়িফুল মা‘আরিফ গ্রন্থে আছে, শামের অধিবাসী তাবিঈগণ যেমন খালিদ ইবনে মা’দান, মাকহুল, লুকমান ইবনে আমির (রা.) ও অন্যান্যগণ শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং এ রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হতেন। (ইবনে রজব, লাতায়িফুল মা‘আরিফ, পৃষ্ঠা ১৯০)
ইবনে তায়মিয়া বলেন, সলফে সালিহীনের কেউ কেউ এ রাতকে সালাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট করে নিতেন। (ইকতিদাউস সিরাত আল মুস্তাকীম, পৃষ্ঠা ২৫৮)
সলফে সালিহীনের অনুসরণে শবে বরাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করতে পারি। যেমন :
(ক) রাতে জাগ্রত থাকা : ইবাদত বন্দেগির উদ্দেশ্যে শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। আরব-অনারবে স্বীকৃত হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফতওয়ার কিতাব ফতওয়ায়ে শামী’তে শবে বরাতে জাগ্রত থাকাকে মানদুব তথা মুস্তাহাব বলা হয়েছে। ফতওয়ায়ে শামী ২য় খন্ডের ‘বাবুল বিতর ওয়ান নাওয়াফিল’ এর মধ্যে আছে- মুস্তাহাব আমলের মধ্যে রয়েছে সফরে বের হওয়ার সময় এবং সফর থেকে ফিরে আসার পর দুই রাকা‘আত নামায পড়া, তাহাজ্জুদের নামায পড়া...... এবং দুই ঈদের রাত, শবে বরাত, রামাদানের শেষ দশ রাত ও যিলহজ্জের প্রথম রাতে জাগ্রত থাকা। (ফতওয়ায়ে শামী, খ- ২, পৃষ্ঠা ২৫-২৭)
মারাকিল ফালাহ গ্রন্থে আছে- শবে বরাতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। কেননা, এটি উক্ত বছরের গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। (মারাকিল ফালাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা-১৭৪) এতে আরো আছে শবে বরাতে জাগ্রত থাকার অর্থ হলো, রাতের অধিক সময় আনুগত্যমূলক কাজে ব্যস্ত থাকা। কেউ কেউ বলেন, রাতের কিছু অংশ কুরআন তিলাওয়াত করবে অথবা তিলাওয়াত শুনবে, অথবা হাদীস পাঠ করবে কিংবা পাঠ শুনবে, তাসবীহ-তাহলীল করবে অথবা দরুদ শরীফ পড়বে। (মারাকিল ফালাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা ১৭৪,)

(খ) কবর যিয়ারত করা ও মৃত আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমানদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা : শবে বরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশেষ আমলের মধ্যে রয়েছে যে, তিনি এ রাতে জান্নাতুল বাকী কবরস্থান যিয়ারত করেছেন এবং মৃত মুমিনদের জন্য দুআ-ইস্তিগফার করেছেন। হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) বলেছেন- শবে বরাতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলের মধ্যে ছাবিত আছে যে, তিনি মুমিন নারী-পুরুষ ও শহীদদের মাগফিরাত কামনার জন্য কবরস্থানে গমন করেছেন। (মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ, শাহরু শা’বান, আল মাকালাতুস সালিসাহ) সুতরাং এ রাতে কবরস্থান যিয়ারত করা, মৃত আত্মীয় স্বজন, পিতা-মাতা ও মুসলমানদের জন্য দু‘আ করা, এবং তাদের মাগফিরাত কামনা করা উত্তম কাজ।

(গ) আল্লাহর দরবারে দু‘আ করা : হাদীস শরীফে আছে, এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। অন্য বর্ণনায় আছে, এ রাতে আল্লাহ পাক এই বলে আহবান করেন : তোমাদের মধ্যে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো প্রার্থনাকারী কি আছে? আমি তার চাহিদা পূর্ণ করে দেব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যেই চাইবে তাকে দান করা হবে, কেবল ব্যভিচারী ও মুশরিক ব্যতীত।
সুতরাং এ রাতে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে নিজের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করা উচিত।

(ঘ) নফল নামায আদায় করা : এ রাতের করণীয় আমলের অন্যতম হলো বেশি বেশি করে নফল নামায আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ সিজদা সহকারে এ রাতের দীর্ঘ সময় নামাযে অতিবাহিত করেছেন। সলফে সালিহীনগণ নামাযের জন্য এ রাতকে খাস করে নিতেন। তবে শবে বরাতের নামাযের জন্য নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই। নিজের মনের চাহিদা অনুযায়ী যত রাকা‘আত ইচ্ছা পড়তে পারেন, যে কোনো সূরা দিয়ে পড়তে পারেন। এ বিষয়ে কোনো শর্ত নেই। দীর্ঘ নামায পড়তে চাইলে এ রাতে সালাতুত তাসবীহ এর নামায পড়া যেতে পারে।
শায়খ ইবনে তায়মিয়া শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতে নামায আদায় করাকে উত্তম বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হলো-
যদি কোনো ব্যক্তি শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে একাকী অথবা বিশেষ জামা‘আতে নামায আদায় করে, যেমন একদল সলফে সালিহীন করতেন, তাহলে এটা উত্তম। (আল ফাতাওয়া আল কুবরা, খ- ২, পৃষ্ঠা ২৬২)


(চ) কুরআন তিলাওয়াত ও শরী‘আত সম্মত অন্যান্য ইবাদত বন্দেগি করা : উপরোক্ত আমলসমূহ ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত, যিক্্র-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, দান-খয়রাতসহ শরী‘আতসম্মত অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে এ রাত অতিবাহিত করা সওয়াবের কাজ। কেননা এসব আমল সব সময়েই উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত।

(ছ) ১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা : ১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা একটি তাৎপর্যপূর্ণ আমল। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিনে সিয়াম পালন করবে। (ইবনে মাজাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা- ৪৪৪)
উল্লেখ্য যে, ১৫ শা’বানের রোযা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত: এটি শা’বান মাসের অন্তর্ভূক্ত একটি দিন, যে মাসে রাসূল (সা.) অধিক রোযা রাখতেন। দ্বিতীয়ত: এটি আইয়ামে বীযের অন্তর্ভূক্ত। আইয়ামে বীয হলো প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তম দিন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ তিন দিন রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তৃতীয়ত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আমরা আলী (রা.) বর্ণিত হাদীসে রয়েছে।
শবে বরাতের করণীয় সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী ‘লাতায়িফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে লিখেছেন- মুমিনগণের জন্য উচিত হলো এ রাতে আল্লাহর যিকরে একান্তভাবে মনোনিবেশ করা এবং নিজের গুনাহ মাফ, দোষ-ত্রুটি গোপন করা ও বিপদাপদ দূর করার জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আর মধ্যে নিবিষ্ট থাকা আর গুনাহের জন্য তাওবা করা। কেননা এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা তাওবা কবূল করেন। পনের শা’বানের রোযার বিষয়ে তিনি বলেছেন,শা’বানের পনের তারিখের রোযা রাখা নিষিদ্ধ নয়। কেননা এটি আইয়্যামে বীযের অন্তর্ভূক্ত, যে দিনগুলোতে প্রত্যেক মাসে রোযা রাখা মুস্তাহাব। আর বিশেষভাবে শা’বানের এ দিনে রোযা রাখারও নির্দেশ রয়েছে। (লাতায়িফুল মা‘আরিফ, পৃষ্ঠা ১৯২)

শবে বরাতে বর্জনীয় কাজসমূহ
শবে বরাত নিয়ে সমাজে কিছু বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে : ১. ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ ও রাস্তা-ঘাটে আলোকসজ্জা করা। ২. বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা। ৩. আতশবাজি করা। ৪. পটকা ফোটানো। ৫. মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো ইত্যাদি। এ সকল বিদআত ও কুসংস্কার থেকে আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন।
শবে বরাত উপলক্ষে ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত বিদআত সম্পর্কে হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) লিখেছেন-ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মানুষ যে সকল নিন্দনীয় বিদআতের প্রচলন করেছে তার মধ্যে রয়েছে প্রদীপ জ্বালিয়ে তা ঘর ও দেয়ালে রাখা এবং এ নিয়ে গর্ব করা, আগুন নিয়ে অনর্থক খেলতামাশার (আতশবাজি) জন্য জমায়েত হওয়া এবং পটকা ফুটানো। (মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ, শাহরু শা’বান, আল মাকালাতুস সালিসাহ)
যেহেতু শা’বান মাস ও পবিত্র রজনী শবে বরাত মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের এক অনন্য সুযোগ সেহেতু এ সময়ে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা আল্লাহর রহমত লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

আল্লাহ আমাদের শবে বরাতকে উত্তম আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।