শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০১৫

আল কুরআনের অনন্য খাদিম

খায়রুল হুদা খান

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ইসলামের বহুমাত্রিক খিদমতের এক মহাপুরুষ, যিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করে গেছেন দীনের তরে, ইসলামের তরে, সমাজের মানুষের উন্নতির লক্ষ্যে। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানুষের কল্যাণ হতে পারে এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যাতে তিনি সময় এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করেন নি। খিদমতে খালক তথা সৃষ্টির সেবা, মানবসেবা, ইসলাম প্রচার, দীনের খিদমত, কুরআনের খিদমত, হাদীসের খিদমত, অসত্য-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সৎকাজে মানুষকে উৎসাহিত করণ, সুসাহিত্য চর্চা ইত্যাদি মানব কল্যাণের সকল ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর সরব পদচারণা। তাঁর এসকল খিদমতের একেকটির বর্ণনা দিয়ে এক একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব। আলোচ্য নিবন্ধে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র কুরআনের খিদমত সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কুরআনের খিদমত করেছেন নানাভাবে। কুরআনের খিদমতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে কুরআন পাকের সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা প্রদান। ছাহেব কিবলাহ এমন এক সময় তাঁর এই খিদমত আরম্ভ করেন যখন এই উপমহাদেশে কুরআন তিলাওয়াতে নানা অসামঞ্জস্যতা দেখা দিয়েছিল। কুরআনের হরফ বিকৃতি, ভুল উচ্চারণসহ অনেক ধরনের ভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনি সময়ে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা দিতে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ’র নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে উপমহাদেশের মানুষ আজ কুরআনের সঠিক তিলাওয়াত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
হযরত ছাহেব কিবলাহ ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় যখন শিক্ষকতায় নিয়োজিত, তখন তাঁর মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোহম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র) তাঁকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেন। উল্লেখ্য, হযরত বদরপুরী (র.) উলামায়ে কিরামকে কিরাত বিশুদ্ধ করার জন্য তাকীদ দিতেন। কিরাত শুদ্ধ না হলে নামায শুদ্ধ হয় না, আর নামায বিশুদ্ধ না হলে কোন ইবাদতই কবূল হয় না, তাই কিরাত শুদ্ধ করা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। উলামা সাধারণের প্রতি বদরপুরী ছাহেব কিবলাহর এ ছিল এক বিশেষ নসীহত। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর কিরাতে বদরপুরী ছাহেব সন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ ছাহেব কিবলাহ স্বীয় মুরশিদ বদরপুরী (র)-এর খিদমতেই কিরাতের তালীম নিয়েছিলেন। হযরত বদরপুরী (র.) কেবল আলিম ও পীর ছিলেন না; বরং সনদপ্রাপ্ত কারীও ছিলেন। তাঁর কিরাতের উস্তাদ হলেন হযরত শায়খ মাওলানা আদুল মজিদ (র.), তিনি সনদ লাভ করেছিলেন হযরত শায়খ মাওলানা আব্দুল ওহাব সিলেটী (র.)-এর কাছ থেকে। তাঁর সনদের সিলসিলা আবূ আমরিদ্দানী (র.) হয়ে রাসূলে কারীম (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। হযরত বদরপুরী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে কিরাতে আরও মাহির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে ফুলতলী ছাহেবকে ইলমে কিরাতের মহান খিদমতের এক গুরুদায়িত্ব আনজাম দিতে হবে। আর তজ্জন্য তাঁকে অর্জন করতে হবে এই বিষয়ে আরও উচ্চতর সমৃদ্ধি।
মুরশিদ কিবলাহর নির্দেশ পেয়ে তিনি হযরত মাওলানা হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে পর্যায়ক্রমে সমস্ত কুরআন শরীফের তিলাওয়াত শুনিয়ে সনদ লাভ করেন। হযরত মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.) শৈশবকাল থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত পিতা-মাতার সাথে মক্কা শরীফে অবস্থান করে ইলমে কিরাত শিক্ষা করেন এবং কুরআন শরীফ হিফয করেন। ইলমে কিরাতে তাঁর উস্তাদ ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কারী ইরকসূস মিসরী (র.)। হযরত ইরকসূস মিসরী (র.) থেকে রাসূল (সা.) পর্যন্ত সনদের ধারাবাহিতা এখানে উল্লেখ করা হল। ৩) হযরত ইরকসূস মিসরী (র.), ৪) শায়খুল কুররা হযরত আবদুল্লাহ আল মক্কী (র.), ৫) হযরত কারী ইবরাহীম সা’দ মিসরী (র.), ৬) হযরত হাসান বাদবার শাফিঈ (র.),  ৭) হযরত মুহাম্মদ আল মুতাওয়াল্লী (র.), ৮) হযরত সায়্যিদ আহমদ তিহামী, ৯) হযরত আহমদ সালমুনা, ১০) হযরত ইবরাহীম আল ‘উবায়দী, ১১) হযরত আবদুর রহমান আল আজহুরী, ১২) হযরত শায়খ আহমদ আল বাকারী, ১৩) হযরত শায়খ মুহাম্মদ আল বাকারী, ১৪) হযরত আবদুর রহমান আল ইয়ামনী, ১৫) হযরত শায়খ শাখ্খাজা, ১৬) হযরত শায়খ আবদুল হক ছানবাতী, ১৭) হযরত শায়খুল ইসলাম জাকারিয়া আল আনসারী, ১৮) হযরত শায়খ দেওয়ান আল আকারী, ১৯) হযরত শায়খ মুহাম্মদ আননাওয়েরী, ২০) হযরত ইমাম মুহাম্মদ আল জাযারী, ২১) হযরত শায়খ ইবনুল লাব্বান, ২২) হযরত শায়খ আহমদ ছিহরা আশশাতবী, ২৩) হযরত শায়খ আবুল হাসান আলী ইবনে হুদাইল, ২৪) হযরত শায়খ আবূ দাঊদ সুলায়মান ইবনে নাজ্জাহ, ২৫) হযরত ইমাম আবূ আমরিদ্দানী, ২৬) হযরত আবুল হাসান তহির ইবনে গালিউন, ২৭) হযরত সালিহ আল-হাশিমী, ২৮) হযরত আহমদ আল উশনানী, ২৯) হযরত মুহাম্মদ ‘উবায়দ আল সাব্বাহ, ৩০) হযরত ইমাম হাফস (র.), ৩১) হযরত ইমাম আছিম ইবন আবুন নুজদ আল কূফী, ৩২) হযরত আবূ আব্দিল্লাহ ইবনে হাবিব আস সালামী ও যুর ইবনে হাবিশ, ৩৩) আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.), হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.), ৩৪) সাইয়িদুল মুরসালীন, শাফিউল মুযনিবীন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের লাওহে মাহফুয থেকে। (সূত্র : আল-কাউলুছ হাদীছ)
১৯৪৪ইং (১৩৫১ বাংলা) সনে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফে যান এবং কিরাতের আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন মিসরীয় বংশোদ্ভূত রাঈসুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (র.)-এর নিকট থেকে। তিনি ছিলেন হারাম শরীফের ইমামগণের পরীক্ষক ও মক্কা শরীফের ফকীহ। তিনি যে কারী ছাহেবের কিরাত বিশুদ্ধ বলে অনুমোদন করতেন তাকেই হারাম শরীফে কিরাত পাঠ করার  অনুমতি দেয়া হত। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে কিরাত শুনানোর অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি ছাহেব কিবলাহ ভারত থেকে এসেছেন জানতে পেরে তাঁর কিরাত শুনতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। কারণ তৎকালীন সময়ে ভারতে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ছিল না বললেই চলে। ছাহেব কিবলাহ জানালেন তিনি হযরত হাফিয মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)-এর নিকট কিরাত শিক্ষা করেছেন যিনি ইরকসুস মিসরী (র.)  এর ছাত্র। আহমদ হিজাযী (র.) করমপুরী (র.)-কে চিনতে না পারলেও ইরকসূস মিসরী (র.)-কে চিনতে পারলেন এবং ছাহেব কিবলাহ’র কিরাত শুনতে সম্মত হলেন। হযরত আহমদ হিজাযী (র.) কিরাতের সনদ লাভ করেছিলেন হযরত আহমদ আদ-দারদীর (র.)-এর কাছ থেকে। তিনি সনদ লাভ করেছিলেন হযরত আযহার শরীফ (র.)-এর কাছ থেকে। তাঁরও সনদ হযরত আবূ আমরিদ্দানী (র.) হয়ে রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র অনন্য সাধারণ গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে একটি ছিল শিক্ষা জীবনে মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বীয় মুরশিদ থেকে তরীকতের খিলাফত লাভ আর অন্যটি ছিল রাঈসুল কুররা আহমদ হিজাযী (র.)-এর ভারত উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সনদ প্রাপ্ত ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা। সনদ প্রদান করে হযরত আহমদ হিজাযী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে ওসীয়ত করে বললেন, ‘এটা একটি আমানত, যে আমানত আমার ইলমে কিরাতের উস্তাদ ও বুযুর্গগণ আমার হাতে রেখেছিলেন। আজ আমি তা তোমার হাতে সোপর্দ করলাম। যদি এই আমানতের হ্রাস-বৃদ্ধিজনিত খেয়ানত কর, তবে তার পরিণাম ফল তুমিই ভোগ করবে। কারণ আজমে (আরব ছাড়া অন্যান্য দেশ) এখন হরফের উচ্চারণ ও পঠন পদ্ধতি বিষয়ে নানারকম মতভেদ দেখা দিয়েছে।’
ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফ হতে ফিরে পুনরায় যথারীতি বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাদান শুরু করেন। একদিন হযরত ছাহেব কিবলাহ ক্লাসে ছাত্রদের দারস দেয়ার সময় সেখানে হযরত মাওলানা আব্দুন নূর গড়কাপনী (র.) তাশরীফ নিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন তিনি । ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁকে সমাদরে পাশে বসতে অনুরোধ করে পাঠদানে ব্যস্ত হলেন।  ক্লাসের সময় শেষ হলে ছাহেব কিবলাহ তাঁর কুশলাদি ও আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি  বললেন, সর্বসাধারণ তো দূরের কথা এতদঞ্চলের বেশ সংখ্যক আলিমেরও কিরাত শুদ্ধ নয় । তাই ছাহেব কিবলাহ দারসে কিরাতের জন্য অন্তত সপ্তাহে এক ঘণ্টা সময় যেন দেন আমাদের। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ জবাবে বললেন, আমার হাতে সময় একেবারে কম, বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্রদের পাঠদানের আগে নিজে ভালোভাবে তা দেখে নিতে হয়, তাই সময় দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। এ কথার পর আব্দুন নূর ছাহেব চলে গেলেন। 
পরদিন ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়ে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলে ছাহেব কিবলাহ আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হযরত আব্দুন নূর (র.) বললেন, আমি নিজে থেকে আপনার নিকট আসিনি। বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েই তবে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন স্বীয় মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.) এর নির্দেশ কিনা জানতে চাইলে হযরত আব্দুন নূর (র.) বললেন, না আরো বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েছি। ছাহেব কিবলাহর পীড়াপীড়িতে তিনি বর্ণনা করলেন, আমি স্বপ্নে হুযূর (সা.)-এর দীদার লাভ করি। হুযূর (সা.)-এর কন্ঠে সুললিত তিলাওয়াতে কালামে পাক শুনতে পাই। আরয করলাম, ইয়া রাসূল্লাল্লাহ (সা.), এই কিরাত কিভাবে শিখব? তখন নবী পাক (সা.) ডান দিকে যাকে ইশারা করলেন, চেয়ে দেখি সেই সৌভাগ্যবান আপনি। একথা শোনার সাথে সাথে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কেঁদে ফেললেন এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পরে নিকটবর্তী হযরত আদম খাকী (র.)  (তিনশত ষাট আউলিয়ার অন্যতম)-এর মাযার সংলগ্ন মসজিদে কিরাতের দারস দেওয়ার ওয়াদা দিলাম। এভাবেই ছাহেব কিবলাহর ইলমে কিরাতের খিদমতের সূত্রপাত। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেটে, ঘোড়ায় চড়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবৈতনিকভাবে কিরাতের দারস দিয়েছেন। যখনই যে অঞ্চলে যেতেন স্থানীয় উলামা-মুদাররিসীন কিরাত শিক্ষার জন্য জমায়েত হয়ে যেতেন। ছাহেব কিবলাহ ধৈর্য সহকারে তাদেরকে কিরাতের মশক দিতেন। ফলে সিলেট ও আসাম অঞ্চলের খ্যাতনামা আলিমগণ তাঁর নিকট থেকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষা করে উপকৃত হয়েছেন। ভারত বিভক্তির পর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বারগাত্তা, কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্বনাথের সৎপুর আলিয়া মাদরাসায় কিরাত শিক্ষা দিয়েছেন।
১৯৫০ ইংরেজি সনে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রথম চালু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন রামাদান মাসকে কিরাত শিক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়। আর রামাদান মাস যেহেতু নুযূলে কুরআনের মাস, তাই প্রতি বৎসর রামাদানে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থী আলিমদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজ খরচে বহন করতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, রান্না-বান্না সবকিছু নিজে তদারকি করতেন। এমনকি নিজে রান্না করে খাইয়েছেন শিক্ষার্থীদেরকে। পঞ্চাশ হতে একশত এভাবে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি সকলকে তালীম দিয়ে এবং সমগ্র কুরআন শরীফ নিজে শুনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী করে তবেই সনদ প্রদান করতেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় অন্যান্য স্থানে শাখাকেন্দ্র অনুমোদন ও একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধক্রমে ছাহেব কিবলাহর ওয়ালিদ মুহতরম হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল মজিদ চৌধুরী মুজাদ্দেদী বরকতী (র.)-এর নামানুসারে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। হযরত ছাহেব কিবলাহ শুরু থেকেই ছিলেন এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় দপ্তর বা বোর্ড অফিস ফুলতলী ছাহেব বাড়ি থেকে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব বিল্ডিং থেকে বছরব্যাপী এর প্রস্তুতি চলতে থাকে। বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে এ পর্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাঁরই বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। ছাহেব কিবলাহ তাঁর ভূ-সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর) এই ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। ছাহেব কিবলাহর জীবদ্দশায়ই এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় এক হাজার শাখা কেন্দ্র বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সকল শাখার মাধ্যমে প্রতি বছর রামাদানে বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা লাভ করে থাকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত ট্রাস্টের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে সকল শাখার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতি রামাদানে বোর্ডের সর্বশেষ জামাত ‘ছাদিছ’-এর পাঠদান ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত প্রধানকেন্দ্রে পরিচালিত হয়। হাজার হাজার ছাত্র মাসব্যাপী এখানে অবস্থান করে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র নিকট থেকে ইলমে কিরাতের দারস গ্রহণ করেছেন। লাভ করেছেন পরিপূর্ণতার সনদ। সনদপ্রাপ্ত কারীসাহেবগণ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেন বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের সুর। এত বিশাল সংখ্যক মানুষ কোন এক ব্যক্তির কাছে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিখতে পেরেছে এমন নযীর পৃথিবীতে হয়তো দ্বিতীয়টি নেই।
ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ছাহেব কিবলাহ প্রতি রামাদান মাসে নিজ বাড়ি ফুলতলীতে অবস্থান করে আগত হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়মিত কিরাত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন ছিল তাঁর এই খিদমত। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিরাত প্রশিক্ষণ দিতেন। বাদ যুহর কিছুক্ষণ তাফসীর বয়ান করতেন। রামাদান ছাড়াও সপ্তাহে দু’দিন শনি ও রবিবার বাদ যুহর ছাহেব বাড়ি জামে মসজিদে ফুলতলী কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও সমবেত মুসল্লীদের এবং প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাযের পূর্বে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাটে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত হাজী নওয়াব আলী জামে মসজিদে সোবহানীঘাট কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও সমবেত মুসল্লীদের তিনি নিয়মিত কিরাত প্রশিক্ষণ দিতেন।
কিরাতের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন ইলমে তাজবীদের উপর সহায়ক গ্রন্থ। মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কিরাত শিক্ষা দেয়া আরম্ভ করেন। তাজবীদের নিয়মাবলী শিক্ষার্থীদেরকে বলে দিতেন। কিন্তু এর দ্বারা সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে সকল নিয়মাবলী আয়ত্ত্ব করা সম্ভব হতনা। তাই আল্লামা ছাহেব কিবলাহ উর্দু ভাষায় রচনা করলেন ‘আল কাউলুছ ছাদীদ’ নামে অত্যন্ত সুরচিত ও সহজবোধ্য তাজবীদের কিতাব, যা বর্তমানে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আল কুরআনের সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা অর্জনে সহায়ত করে আসছে।
ফুলতলীতে অবস্থান করে যারা কিরাত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা দেখেছেন কুরআনের এই খিদমতে আল্লামা ছাহেব কিবলাহর আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা। সময় হওয়ার আগেই ক্লাসে উপস্থিত হওয়া, তুলনামুলক দুর্বল ছাত্রদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন আদর্শ অভিভাবক।
আল কুরআনের খিদমতের আরেকটি দিক হচ্ছে কুরআনের হুকুম-আহকাম, বিধানাবলী মানুষকে শিক্ষা দেওয়া, শিক্ষা অর্জনে অনুপ্রাণিত করা। আল কুরআনের এই খিদমতেও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র রয়েছে অনন্য অবদান। তিনি নিজে একজন সুবক্তা হিসেবে দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন মাহফিলে আল কুরআনের হুকুম আহকাম, ইসলামের সঠিক আকীদা-বিশ্বাসকে জনসমাজে তুলে ধরেছেন। মানুষকে দেখিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। বার্ধক্যে উপনীত হয়েও দীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও ইকামতে দীনের সুকঠিন দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো বিচলিত হন নি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর খিদমত কেবল ইলমে কিরাতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি এর পাশাপাশি ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইলমে তাসাওউফসহ সকল বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করে তাঁর অমীয় সুধা বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি রচনা করেছেন আল কুরআনের তাফসীর বিষয়ে সমৃদ্ধ দালীলিক গ্রন্থ ‘আত তানভীর আলাত তাফসীর’, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা নির্ভর বারো চাঁদের খুতবা ‘আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া’সহ অনেক গ্রন্থ। আল কুরআন, আল হাদীস ও ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য ইসলামী প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কুরআন, হাদীস ও ফিকহের দারস প্রদান করেছেন দীর্ঘকাল। প্রাতিষ্ঠানিক গ-ির বাইরে থেকেও বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসায় ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ইলমে হাদীসের দারস দিয়ে গেছেন। ইলমে তরীকত, শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি। গঠন করে গেছেন অসংখ্য আলিমে দীন। রেখে গেছেন তাঁর সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর দীনী সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকুক, তাঁর সকল খিদমত কবূল হোক আল্লাহর দরবারে, এই কামনা আমাদের। আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁর রেখে যাওয়া সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কাজ করে যাওয়ার তাওফীক দান করুন।

[লেখক : ইমাম ও খতীব, শাহজালাল মসজিদ এন্ড ইসলামিক সেন্টার
ম্যানচেস্টার, ইউকে]
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন