শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টিতে যঈফ হাদীসের উপর আমল করা জায়িয ও মুস্তাহাব

[মুফতী মাওলানা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী’র ‘তাকলীদ-এর সুদৃঢ় রজ্জু’ থেকে]
গায়র মুকল্লিদগণ হাফিয ইবনে তাইমিয়ার অনুসরণ করেন বলে দাবি করেন অথচ ইবনে তাইমিয়া মৃতের তালকীন সম্পর্কে বলেন-
وروى في تلقين الميت بعد الدفن حديث فيه نظر، لكن عمل به رجال من أهل الشام الأولين، مع روايتهم له، فلذلك استحبه أكثر أصحابنا وغيرهم. (إقتضاء الصراط المستقيم)
অর্থাৎ মৃতের দাফনের পর তালকীন সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণিত তার সনদ দুর্বল। কিন্তু পূর্বসুরী শামের আলিমগণ এর উপর আমল করেছেন। এ কারণে আমাদের অধিকাংশ লোকদের নিকট ও অন্যান্যদের নিকট তা মুস্তাহাব। (ইকতিদাউস সিরাতাল মুস্তাকীম)
ইবনে তাইমিয়ার উক্ত মন্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসের সনদে দুর্বলতা থাকলেও অর্থাৎ হাদীস যঈফ হওয়া সত্ত্বেও তার উপর আমল করা জায়িয ও মুস্তাহাব।
হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযীওالروح কিতাবে তালকীনকে মুস্তাহাব বলেছেন।
উল্লেখ্য, আল্লাহর রাসূলের হাদীস নয় এমন কোন উক্তিকে তাঁর উক্তি বলা প্রসঙ্গে যেমন ভয়ংকর পরিণতির কথা হাদীসে উল্লেখ রয়েছে তেমনি কোন হাদীসকে হাদীস না বলাও হাদীস অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে যায়। বর্তমান সময়ে দেখা যায়, কেউ কেউ কোন কোন হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তা পরিত্যাগ করার সুযোগ অন্বেষন করেন। যেমন কোন হাদীস সম্পর্কে হাদীস বিশেষজ্ঞদের لا يصح (সহীহ নয়), لا يثبت (ছাবিত নেই) ইত্যাদি মন্তব্যকে তারা হাদীস প্রত্যাখ্যানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের এ কৌশল তাদের মুর্খতার পরিচয় প্রদান করে। কারণ উসুলে হাদীসের পরিভাষায় এসব উক্তি হাদীস অগ্রহণযোগ্য হওয়ার দলীল নয়। আল্লামা আব্দুল হাই লখনবী (র.) তাঁর লিখিত কিতাবে এ প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য হাদীস বিশেষজ্ঞদের উক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনÑ কোন কোন মুহাদ্দিসীনে কিরাম কোন হাদীস সম্পর্কেلا يصح (অসহীহ নয়) অথবা لايثبت (সাবিত নেই) মন্তব্য করেন। তা দেখে অনেক অজ্ঞ লোক এটাকে موضوع (মউযু) বা ضعيف (দুর্বল) বলে ধারণা করেন। এটি তাদের হাদীসের পরিভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতার উপর ভিত্তিশীল। মোল্লা আলী কারী (র.)تذكرة الموضوعات কিতাবে লেখেন عدم ثبوت (সাবিত নেই) কথা দ্বারা হাদীস موضوع (মউযু) হওয়াকে আবশ্যক করে না।
হাফিয ইবনে হাজার (র.) الاذكار গ্রন্থের হাদীসের তাখরীজ সম্পর্কিত তদীয় نتائج الافكار কিতাবে লেখেন- ওযুতে বিসমিল্লাহ পড়া প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমি ওযূতে বিসমিল্লাহ পড়া সম্পর্কিত কোন হাদীস জানি না। আমি বলি, কারো না জানা বাস্তবে তা না থাকা সাবিত করে না। যদি তা মেনে নেওয়াও হয় তবুও সাবিত না থাকা যঈফ হওয়াকে সাবিত করে না। কারণ হতে পারেثابت (প্রমাণিত) দ্বারাصحيح (সহীহ) বুঝানো হয়েছে, তাহলে তা حسن (হাসান) হতে পারে। যদি তাও মেনে নেয়া যায়; তাহলেও প্রত্যেক فرد এর নফী দ্বারা পুরো বিষয়টি نفي (না বাচক) হয়ে যায় না।
নূর উদ্দীন সামহুদী الشرفين فضل فى العقدين جواهر এর মধ্যে বলেন: আশুরার দিনে পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি বেশি খরচ করার হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র.)-এর উক্তি لا يصح (সহীহ নয়) দ্বারা তা বাতিল হয়ে যায় না। বরং এটি غير صحيح (সহীহ নয় এমন) হতে পারে যা দলীল হিসেবে গ্রহণের যোগ্য, যখন এটি ‘হাসান’ হবে। এর স্তর সহীহ ও যঈফ হাদীসের মধ্যখানে।
যরকশী نكت ابن الصلاح গ্রন্থে বলেন, আমাদের কথা موضوع (মউযু) ও لا يصح (সহীহ নয়) এর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কারণ প্রথমটি মিথ্যা হওয়া সাবিত করে অপরদিকে দ্বিতীয়টি সাবিত না থাকার সংবাদ দেয়। আর সাবিত না থাকা বাস্তবে না থাকা বুঝায় না। একথা এমন সকল হাদীসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যেগুলো সম্পর্কে ইবনুল জাওযী لا يصح (সহীহ নয়) বলেছেন।
মোল্লা আলী কারী বলেছেন সাখাবীর উক্তি لا يصح (সহীহ নয়) যঈফ ও হাসানকে নফী করে না।
যুরকানী বলেন- আল্লামা কাসতালানী (র.) ইবনে রজব থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবনে হিব্বান একে সহীহ বলেছেন। এতে ইবনে দেহইয়ার সেই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যাতে তিনি বলেছিলেন- ‘শাবানের মধ্যরাতের ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই।’ যদিও তিনি সহীহ দ্বারা পারিভাষিক সহীহ বুঝিয়েছেন। কারণ মু‘আয (রা.)-এর হাদীস সহীহ নয় বরং হাসান। (আর রাফউ ওয়াত তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত তা‘দীল, পৃষ্ঠা ১৯১-১৯৭)

রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৫

শাফাআত

মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

হাশরের মাঠে গোনাহগারদের জন্য রাসূল (সা.) ও নেক্কার উম্মতগণের শাফাআত হাদীসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত। খারেজী, মুতাযিলাসহ কিছু ভ্রান্ত দল শাফাআতকে অস্বীকার করেন। খারেজীদের বক্তব্য হলো কবীরা গোনাহকারী কাফির। আর কাফিরদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। মু’তাযিলারা শাফা’আতকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তাদের দৃষ্টিতে শাফাআত হলো নেক্কারদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। শাফাআতের মাধ্যমে গুনাহগারদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া অসম্ভব। বর্তমানে নব্য কিছু দল মুতলাকান গোনাহগারদের জন্য রাসূল (সা.)-এর শাফাআতকে অস্বীকার করেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো কিয়ামতের দিন রাসূল (সা.) সহ অন্যান্য নেক্কারগণ এমন গুনাহগার উম্মতের জন্য শাফাআত করবেন, যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত। সুনানে ইবনে মাজাহ-তে হযরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোক শাফা‘আত করবেন। নবীগণ, আলিমগণ এবং শহীদগণ।
শাফাআতের সর্বোচ্চ স্তর হলো শাফাআতে কুবরা। এটি রাসূল (সা.)-এর জন্য নির্দিষ্ঠ। কিয়ামতের ভয়াল মাঠের ভিষন কষ্ঠ থেকে সমস্ত মাখলূককে মুক্তি দিয়ে বিচারকার্য শুরু করার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে রাসূল (সা.) সুপারিশ করবেন। এই শাফাআত সম্পর্কে বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- যখন কিয়ামতের দিন লোকেরা সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো পেরেশান হয়ে যাবে তখন তারা আদম (আ.)-এর কাছে আসবে এবং বলবে, আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য শাফাআত করুন। তিনি বলবেন আমি এর উপযুক্ত নই, তোমরা ইবরাহীম (আ.)-এর কাছে যাও; তিনি আল্লাহর খলীল। এরপর সবাই ইবরাহীস (আ.)-এর কাছে এসে শাফাআতের জন্য আরজ করবে। তিনি বলবেন আমি এর উপযুক্ত নই, তোমরা মূসা (আ.)-এর কাছে যাও। কেননা তিনি কালীমুল্লাহ। এরপর লোকের তার কাছে আসবে এবং শাফাআতের আবেদন করবে। তিনি বলবেন- আমি এর উপযুক্ত নই। তোমরা ঈসা (আ.)-এর কাছে যাও, কেননা তিনি রূহুল্লাহ ও কালিমাতুল্লাহ। এরপর লোকেরা ঈসা (আ.)-এর কাছে আসবে এবং শাফাআতের আরজ করবে। তিনিও বলবেন আমি এর উপযুক্ত নই, তোমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট যাও। 
এরপর সবাই আমার নিকট আসবে এবং মহান আল্লাহর কাছে শাফাআতের জন্য বলবে। আমি বলব হ্যাঁ! আমি এই কাজের উপযুক্ত। অতপর আমি আমার রবের দরবারে অনুমতি চাইব, আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। এরপর আমার অন্তরে কিছু প্রশংসামূলক শব্দ তৈরী  করে দেওয়া হবে যার মাধ্যমে আমি আমার রবের প্রশংসা করব। তারপর আমি মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় অবনত হব। এরপর আমাকে বলা হবে-
 يا محمد! ارفع رأسك وقل يسمع لك وسل تعط واشفع تشفع، فأقول رب أمتي أمتي
হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনার মাথা তুলুন। আপনি বলুন আপনার কথা শুনা হবে, আপনি চান আপনাকে প্রদান করা হবে, আপনি শাফাআত করুন আপনার শাফাআত কবূল করা হবে। তখন আমি বলব- হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত।
বুখারী শরীফে অপর হাদীসে রাসূল (সা.)-এর এই বিশেষ সম্মানকে “মাকামে মাহমূদ” বলা হয়েছে।
এই শাফাআত আমাদের নবীর জন্য খাস বা নির্দিষ্ঠ। 

রাসূল (সা.) কিয়ামতের দিন তার উম্মতের মধ্যে যারা জাহান্নামী তাদের মুক্তির জন্য শাফাআত করবেন। ইবনে মাজাহ ও মুসনদে আহমদে হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা.) হতে বর্ণিত আছে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- আমাকে শাফাআত এবং আমর অর্ধেক উম্মতকে (বিনা হিনাবে) বেহেশতে প্রবেশ করানোর ব্যপারে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। আমি শাফাআত করাকে গ্রহণ করেছি, কেননা এটা অধিক ব্যাপত এবং যথেষ্ট হবে। তোমরা মনে করো না শাফাআত শুধুমাত্র মুত্তাকীদের জন্য। বরং ইহা গুনাহগার, পাপী ও অপরাধীদের জন্য।
তিরমিযী শরীফে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে-
قال رسول الله صلي الله عليه وسلم شفاعتي لأهل الكبائر من أمتي
আমার উম্মতের মধ্যে কবীরা গুনাহকারীদের জন্য আমার শাফাআত।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ দারদা (রাদ্বি.) হতেও অনুরূপ বর্ণনা আছ্।ে

অন্যান্য নবীগণের শাফাআত
ইবনে মাজাহ ও বায়হাকীতে হযরত জাবির (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যখন জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মধ্যে পার্থক্য করা হবে তখন জান্নাতীরা জান্নাতে ও জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রকেশ করবে। এরপর রাসূলগণ দাঁড়াবেন এবং (জাহান্নামীদের জন্য) শাফাআত করবেন। রাসূলদেরকে বলা হবে আপনারা যান, এবং যাদেরকে চিনেন তাদেরকে (জাহান্নাম) থেকে বের করে আনেন। অতপর রাসূলগণ এমন কিছু লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন যারা আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। তাদেরকে নদীতে নিক্ষেপ করা হবে এবং সাদা ক্কড়ার মতো হয়ে বের হবে।............................ অবশেষে যাদের অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে তাদেরকে রাসূলগণ শাফাআত করে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে নিবেন। তাদের গর্দানে লিখা থাকবে عتاء الله  মহান আল্লাহ কর্তৃক মুক্ত।
মুসনাদে আহমদ ও তাবারানীতে বর্ণিত আছে- রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে মুক্তি প্রদান করবেন। অতপর ফিরিশতা, নবীগণ, সিদ্দিকীন ও শহীদগণকে শাফাআতের অনুমতি দিবেন।

আউলিয়াদের শাফাআত
তিরমিযী শরীফে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বণিূত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক আছেন যারা তাদের সমর্থক ও অনুসারীদের শাফাআত করবেন। কিছু লোক আছেন যারা তাদের গোত্রের জন্য শাফাআত করবেন, আর কিছু লোক আছেন যারা একটি দলের জন্য শাফাআত করবেন। আর কিছু লোক আছেন যারা একক জনের জন্য শাফাআত করবেন, এভাবে সবাই জান্নাতে যাবে।

হাফিযে কুরআনদের শাফাআত
তিরমিযী শরীফে হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পাঠ করল এবং হিফয করল, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা্েবন এবং তার বংশধর থেকে এমন দশজনকে তার শাফাআতে জান্নাতে দিবেন যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত। 

শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০১৫

আল কুরআনের অনন্য খাদিম

খায়রুল হুদা খান

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ইসলামের বহুমাত্রিক খিদমতের এক মহাপুরুষ, যিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করে গেছেন দীনের তরে, ইসলামের তরে, সমাজের মানুষের উন্নতির লক্ষ্যে। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানুষের কল্যাণ হতে পারে এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যাতে তিনি সময় এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করেন নি। খিদমতে খালক তথা সৃষ্টির সেবা, মানবসেবা, ইসলাম প্রচার, দীনের খিদমত, কুরআনের খিদমত, হাদীসের খিদমত, অসত্য-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সৎকাজে মানুষকে উৎসাহিত করণ, সুসাহিত্য চর্চা ইত্যাদি মানব কল্যাণের সকল ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর সরব পদচারণা। তাঁর এসকল খিদমতের একেকটির বর্ণনা দিয়ে এক একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব। আলোচ্য নিবন্ধে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র কুরআনের খিদমত সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কুরআনের খিদমত করেছেন নানাভাবে। কুরআনের খিদমতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে কুরআন পাকের সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা প্রদান। ছাহেব কিবলাহ এমন এক সময় তাঁর এই খিদমত আরম্ভ করেন যখন এই উপমহাদেশে কুরআন তিলাওয়াতে নানা অসামঞ্জস্যতা দেখা দিয়েছিল। কুরআনের হরফ বিকৃতি, ভুল উচ্চারণসহ অনেক ধরনের ভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনি সময়ে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা দিতে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ’র নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে উপমহাদেশের মানুষ আজ কুরআনের সঠিক তিলাওয়াত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
হযরত ছাহেব কিবলাহ ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় যখন শিক্ষকতায় নিয়োজিত, তখন তাঁর মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোহম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র) তাঁকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেন। উল্লেখ্য, হযরত বদরপুরী (র.) উলামায়ে কিরামকে কিরাত বিশুদ্ধ করার জন্য তাকীদ দিতেন। কিরাত শুদ্ধ না হলে নামায শুদ্ধ হয় না, আর নামায বিশুদ্ধ না হলে কোন ইবাদতই কবূল হয় না, তাই কিরাত শুদ্ধ করা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। উলামা সাধারণের প্রতি বদরপুরী ছাহেব কিবলাহর এ ছিল এক বিশেষ নসীহত। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর কিরাতে বদরপুরী ছাহেব সন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ ছাহেব কিবলাহ স্বীয় মুরশিদ বদরপুরী (র)-এর খিদমতেই কিরাতের তালীম নিয়েছিলেন। হযরত বদরপুরী (র.) কেবল আলিম ও পীর ছিলেন না; বরং সনদপ্রাপ্ত কারীও ছিলেন। তাঁর কিরাতের উস্তাদ হলেন হযরত শায়খ মাওলানা আদুল মজিদ (র.), তিনি সনদ লাভ করেছিলেন হযরত শায়খ মাওলানা আব্দুল ওহাব সিলেটী (র.)-এর কাছ থেকে। তাঁর সনদের সিলসিলা আবূ আমরিদ্দানী (র.) হয়ে রাসূলে কারীম (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। হযরত বদরপুরী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে কিরাতে আরও মাহির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে ফুলতলী ছাহেবকে ইলমে কিরাতের মহান খিদমতের এক গুরুদায়িত্ব আনজাম দিতে হবে। আর তজ্জন্য তাঁকে অর্জন করতে হবে এই বিষয়ে আরও উচ্চতর সমৃদ্ধি।
মুরশিদ কিবলাহর নির্দেশ পেয়ে তিনি হযরত মাওলানা হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে পর্যায়ক্রমে সমস্ত কুরআন শরীফের তিলাওয়াত শুনিয়ে সনদ লাভ করেন। হযরত মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.) শৈশবকাল থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত পিতা-মাতার সাথে মক্কা শরীফে অবস্থান করে ইলমে কিরাত শিক্ষা করেন এবং কুরআন শরীফ হিফয করেন। ইলমে কিরাতে তাঁর উস্তাদ ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কারী ইরকসূস মিসরী (র.)। হযরত ইরকসূস মিসরী (র.) থেকে রাসূল (সা.) পর্যন্ত সনদের ধারাবাহিতা এখানে উল্লেখ করা হল। ৩) হযরত ইরকসূস মিসরী (র.), ৪) শায়খুল কুররা হযরত আবদুল্লাহ আল মক্কী (র.), ৫) হযরত কারী ইবরাহীম সা’দ মিসরী (র.), ৬) হযরত হাসান বাদবার শাফিঈ (র.),  ৭) হযরত মুহাম্মদ আল মুতাওয়াল্লী (র.), ৮) হযরত সায়্যিদ আহমদ তিহামী, ৯) হযরত আহমদ সালমুনা, ১০) হযরত ইবরাহীম আল ‘উবায়দী, ১১) হযরত আবদুর রহমান আল আজহুরী, ১২) হযরত শায়খ আহমদ আল বাকারী, ১৩) হযরত শায়খ মুহাম্মদ আল বাকারী, ১৪) হযরত আবদুর রহমান আল ইয়ামনী, ১৫) হযরত শায়খ শাখ্খাজা, ১৬) হযরত শায়খ আবদুল হক ছানবাতী, ১৭) হযরত শায়খুল ইসলাম জাকারিয়া আল আনসারী, ১৮) হযরত শায়খ দেওয়ান আল আকারী, ১৯) হযরত শায়খ মুহাম্মদ আননাওয়েরী, ২০) হযরত ইমাম মুহাম্মদ আল জাযারী, ২১) হযরত শায়খ ইবনুল লাব্বান, ২২) হযরত শায়খ আহমদ ছিহরা আশশাতবী, ২৩) হযরত শায়খ আবুল হাসান আলী ইবনে হুদাইল, ২৪) হযরত শায়খ আবূ দাঊদ সুলায়মান ইবনে নাজ্জাহ, ২৫) হযরত ইমাম আবূ আমরিদ্দানী, ২৬) হযরত আবুল হাসান তহির ইবনে গালিউন, ২৭) হযরত সালিহ আল-হাশিমী, ২৮) হযরত আহমদ আল উশনানী, ২৯) হযরত মুহাম্মদ ‘উবায়দ আল সাব্বাহ, ৩০) হযরত ইমাম হাফস (র.), ৩১) হযরত ইমাম আছিম ইবন আবুন নুজদ আল কূফী, ৩২) হযরত আবূ আব্দিল্লাহ ইবনে হাবিব আস সালামী ও যুর ইবনে হাবিশ, ৩৩) আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.), হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.), ৩৪) সাইয়িদুল মুরসালীন, শাফিউল মুযনিবীন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের লাওহে মাহফুয থেকে। (সূত্র : আল-কাউলুছ হাদীছ)
১৯৪৪ইং (১৩৫১ বাংলা) সনে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফে যান এবং কিরাতের আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন মিসরীয় বংশোদ্ভূত রাঈসুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (র.)-এর নিকট থেকে। তিনি ছিলেন হারাম শরীফের ইমামগণের পরীক্ষক ও মক্কা শরীফের ফকীহ। তিনি যে কারী ছাহেবের কিরাত বিশুদ্ধ বলে অনুমোদন করতেন তাকেই হারাম শরীফে কিরাত পাঠ করার  অনুমতি দেয়া হত। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে কিরাত শুনানোর অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি ছাহেব কিবলাহ ভারত থেকে এসেছেন জানতে পেরে তাঁর কিরাত শুনতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। কারণ তৎকালীন সময়ে ভারতে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ছিল না বললেই চলে। ছাহেব কিবলাহ জানালেন তিনি হযরত হাফিয মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)-এর নিকট কিরাত শিক্ষা করেছেন যিনি ইরকসুস মিসরী (র.)  এর ছাত্র। আহমদ হিজাযী (র.) করমপুরী (র.)-কে চিনতে না পারলেও ইরকসূস মিসরী (র.)-কে চিনতে পারলেন এবং ছাহেব কিবলাহ’র কিরাত শুনতে সম্মত হলেন। হযরত আহমদ হিজাযী (র.) কিরাতের সনদ লাভ করেছিলেন হযরত আহমদ আদ-দারদীর (র.)-এর কাছ থেকে। তিনি সনদ লাভ করেছিলেন হযরত আযহার শরীফ (র.)-এর কাছ থেকে। তাঁরও সনদ হযরত আবূ আমরিদ্দানী (র.) হয়ে রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র অনন্য সাধারণ গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে একটি ছিল শিক্ষা জীবনে মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বীয় মুরশিদ থেকে তরীকতের খিলাফত লাভ আর অন্যটি ছিল রাঈসুল কুররা আহমদ হিজাযী (র.)-এর ভারত উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সনদ প্রাপ্ত ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা। সনদ প্রদান করে হযরত আহমদ হিজাযী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে ওসীয়ত করে বললেন, ‘এটা একটি আমানত, যে আমানত আমার ইলমে কিরাতের উস্তাদ ও বুযুর্গগণ আমার হাতে রেখেছিলেন। আজ আমি তা তোমার হাতে সোপর্দ করলাম। যদি এই আমানতের হ্রাস-বৃদ্ধিজনিত খেয়ানত কর, তবে তার পরিণাম ফল তুমিই ভোগ করবে। কারণ আজমে (আরব ছাড়া অন্যান্য দেশ) এখন হরফের উচ্চারণ ও পঠন পদ্ধতি বিষয়ে নানারকম মতভেদ দেখা দিয়েছে।’
ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফ হতে ফিরে পুনরায় যথারীতি বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাদান শুরু করেন। একদিন হযরত ছাহেব কিবলাহ ক্লাসে ছাত্রদের দারস দেয়ার সময় সেখানে হযরত মাওলানা আব্দুন নূর গড়কাপনী (র.) তাশরীফ নিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন তিনি । ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁকে সমাদরে পাশে বসতে অনুরোধ করে পাঠদানে ব্যস্ত হলেন।  ক্লাসের সময় শেষ হলে ছাহেব কিবলাহ তাঁর কুশলাদি ও আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি  বললেন, সর্বসাধারণ তো দূরের কথা এতদঞ্চলের বেশ সংখ্যক আলিমেরও কিরাত শুদ্ধ নয় । তাই ছাহেব কিবলাহ দারসে কিরাতের জন্য অন্তত সপ্তাহে এক ঘণ্টা সময় যেন দেন আমাদের। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ জবাবে বললেন, আমার হাতে সময় একেবারে কম, বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্রদের পাঠদানের আগে নিজে ভালোভাবে তা দেখে নিতে হয়, তাই সময় দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। এ কথার পর আব্দুন নূর ছাহেব চলে গেলেন। 
পরদিন ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়ে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলে ছাহেব কিবলাহ আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হযরত আব্দুন নূর (র.) বললেন, আমি নিজে থেকে আপনার নিকট আসিনি। বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েই তবে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন স্বীয় মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.) এর নির্দেশ কিনা জানতে চাইলে হযরত আব্দুন নূর (র.) বললেন, না আরো বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েছি। ছাহেব কিবলাহর পীড়াপীড়িতে তিনি বর্ণনা করলেন, আমি স্বপ্নে হুযূর (সা.)-এর দীদার লাভ করি। হুযূর (সা.)-এর কন্ঠে সুললিত তিলাওয়াতে কালামে পাক শুনতে পাই। আরয করলাম, ইয়া রাসূল্লাল্লাহ (সা.), এই কিরাত কিভাবে শিখব? তখন নবী পাক (সা.) ডান দিকে যাকে ইশারা করলেন, চেয়ে দেখি সেই সৌভাগ্যবান আপনি। একথা শোনার সাথে সাথে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কেঁদে ফেললেন এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পরে নিকটবর্তী হযরত আদম খাকী (র.)  (তিনশত ষাট আউলিয়ার অন্যতম)-এর মাযার সংলগ্ন মসজিদে কিরাতের দারস দেওয়ার ওয়াদা দিলাম। এভাবেই ছাহেব কিবলাহর ইলমে কিরাতের খিদমতের সূত্রপাত। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেটে, ঘোড়ায় চড়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবৈতনিকভাবে কিরাতের দারস দিয়েছেন। যখনই যে অঞ্চলে যেতেন স্থানীয় উলামা-মুদাররিসীন কিরাত শিক্ষার জন্য জমায়েত হয়ে যেতেন। ছাহেব কিবলাহ ধৈর্য সহকারে তাদেরকে কিরাতের মশক দিতেন। ফলে সিলেট ও আসাম অঞ্চলের খ্যাতনামা আলিমগণ তাঁর নিকট থেকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষা করে উপকৃত হয়েছেন। ভারত বিভক্তির পর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বারগাত্তা, কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্বনাথের সৎপুর আলিয়া মাদরাসায় কিরাত শিক্ষা দিয়েছেন।
১৯৫০ ইংরেজি সনে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রথম চালু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন রামাদান মাসকে কিরাত শিক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়। আর রামাদান মাস যেহেতু নুযূলে কুরআনের মাস, তাই প্রতি বৎসর রামাদানে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থী আলিমদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজ খরচে বহন করতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, রান্না-বান্না সবকিছু নিজে তদারকি করতেন। এমনকি নিজে রান্না করে খাইয়েছেন শিক্ষার্থীদেরকে। পঞ্চাশ হতে একশত এভাবে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি সকলকে তালীম দিয়ে এবং সমগ্র কুরআন শরীফ নিজে শুনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী করে তবেই সনদ প্রদান করতেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় অন্যান্য স্থানে শাখাকেন্দ্র অনুমোদন ও একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধক্রমে ছাহেব কিবলাহর ওয়ালিদ মুহতরম হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল মজিদ চৌধুরী মুজাদ্দেদী বরকতী (র.)-এর নামানুসারে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। হযরত ছাহেব কিবলাহ শুরু থেকেই ছিলেন এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় দপ্তর বা বোর্ড অফিস ফুলতলী ছাহেব বাড়ি থেকে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব বিল্ডিং থেকে বছরব্যাপী এর প্রস্তুতি চলতে থাকে। বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে এ পর্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাঁরই বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। ছাহেব কিবলাহ তাঁর ভূ-সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর) এই ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। ছাহেব কিবলাহর জীবদ্দশায়ই এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় এক হাজার শাখা কেন্দ্র বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সকল শাখার মাধ্যমে প্রতি বছর রামাদানে বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা লাভ করে থাকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত ট্রাস্টের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে সকল শাখার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতি রামাদানে বোর্ডের সর্বশেষ জামাত ‘ছাদিছ’-এর পাঠদান ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত প্রধানকেন্দ্রে পরিচালিত হয়। হাজার হাজার ছাত্র মাসব্যাপী এখানে অবস্থান করে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র নিকট থেকে ইলমে কিরাতের দারস গ্রহণ করেছেন। লাভ করেছেন পরিপূর্ণতার সনদ। সনদপ্রাপ্ত কারীসাহেবগণ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেন বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের সুর। এত বিশাল সংখ্যক মানুষ কোন এক ব্যক্তির কাছে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিখতে পেরেছে এমন নযীর পৃথিবীতে হয়তো দ্বিতীয়টি নেই।
ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ছাহেব কিবলাহ প্রতি রামাদান মাসে নিজ বাড়ি ফুলতলীতে অবস্থান করে আগত হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়মিত কিরাত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন ছিল তাঁর এই খিদমত। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিরাত প্রশিক্ষণ দিতেন। বাদ যুহর কিছুক্ষণ তাফসীর বয়ান করতেন। রামাদান ছাড়াও সপ্তাহে দু’দিন শনি ও রবিবার বাদ যুহর ছাহেব বাড়ি জামে মসজিদে ফুলতলী কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও সমবেত মুসল্লীদের এবং প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাযের পূর্বে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাটে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত হাজী নওয়াব আলী জামে মসজিদে সোবহানীঘাট কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও সমবেত মুসল্লীদের তিনি নিয়মিত কিরাত প্রশিক্ষণ দিতেন।
কিরাতের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন ইলমে তাজবীদের উপর সহায়ক গ্রন্থ। মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কিরাত শিক্ষা দেয়া আরম্ভ করেন। তাজবীদের নিয়মাবলী শিক্ষার্থীদেরকে বলে দিতেন। কিন্তু এর দ্বারা সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে সকল নিয়মাবলী আয়ত্ত্ব করা সম্ভব হতনা। তাই আল্লামা ছাহেব কিবলাহ উর্দু ভাষায় রচনা করলেন ‘আল কাউলুছ ছাদীদ’ নামে অত্যন্ত সুরচিত ও সহজবোধ্য তাজবীদের কিতাব, যা বর্তমানে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আল কুরআনের সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা অর্জনে সহায়ত করে আসছে।
ফুলতলীতে অবস্থান করে যারা কিরাত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা দেখেছেন কুরআনের এই খিদমতে আল্লামা ছাহেব কিবলাহর আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা। সময় হওয়ার আগেই ক্লাসে উপস্থিত হওয়া, তুলনামুলক দুর্বল ছাত্রদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন আদর্শ অভিভাবক।
আল কুরআনের খিদমতের আরেকটি দিক হচ্ছে কুরআনের হুকুম-আহকাম, বিধানাবলী মানুষকে শিক্ষা দেওয়া, শিক্ষা অর্জনে অনুপ্রাণিত করা। আল কুরআনের এই খিদমতেও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র রয়েছে অনন্য অবদান। তিনি নিজে একজন সুবক্তা হিসেবে দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন মাহফিলে আল কুরআনের হুকুম আহকাম, ইসলামের সঠিক আকীদা-বিশ্বাসকে জনসমাজে তুলে ধরেছেন। মানুষকে দেখিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। বার্ধক্যে উপনীত হয়েও দীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও ইকামতে দীনের সুকঠিন দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো বিচলিত হন নি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর খিদমত কেবল ইলমে কিরাতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি এর পাশাপাশি ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইলমে তাসাওউফসহ সকল বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করে তাঁর অমীয় সুধা বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি রচনা করেছেন আল কুরআনের তাফসীর বিষয়ে সমৃদ্ধ দালীলিক গ্রন্থ ‘আত তানভীর আলাত তাফসীর’, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা নির্ভর বারো চাঁদের খুতবা ‘আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া’সহ অনেক গ্রন্থ। আল কুরআন, আল হাদীস ও ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য ইসলামী প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কুরআন, হাদীস ও ফিকহের দারস প্রদান করেছেন দীর্ঘকাল। প্রাতিষ্ঠানিক গ-ির বাইরে থেকেও বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসায় ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ইলমে হাদীসের দারস দিয়ে গেছেন। ইলমে তরীকত, শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি। গঠন করে গেছেন অসংখ্য আলিমে দীন। রেখে গেছেন তাঁর সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর দীনী সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকুক, তাঁর সকল খিদমত কবূল হোক আল্লাহর দরবারে, এই কামনা আমাদের। আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁর রেখে যাওয়া সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কাজ করে যাওয়ার তাওফীক দান করুন।

[লেখক : ইমাম ও খতীব, শাহজালাল মসজিদ এন্ড ইসলামিক সেন্টার
ম্যানচেস্টার, ইউকে]
 

সাহাবায়ে কিরামের তাকলীদ

আল্লামা মুফতী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী

সাহাবায়ে কিরামের যুগে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে অভিজ্ঞ, ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের তাকলীদ প্রচলিত ছিল যা মওকুফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তন্মধ্যে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হল।
০১। হযরত উমর (রা.)-এর নির্দেশ:
عَن عكرمةَ عن بن عباس قال خطب عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ خَطَبَ النَّاسَ بِالْجَابِيَةِ فَقَالَ : مَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقُرْآنِ فَلْيَأْتِ أُبَىَّ بْنَ كَعْبٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفَرَائِضِ فَلْيَأَتِ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفِقْهِ فَلْيَأْتِ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْمَالِ فَلْيَأْتِنِى فَإِنَّ اللهَ تَعَالٰى جَعَلَنِى لَهُ والِيًا وَقَاسِمًا.
অর্থাৎ হযরত ইকরামাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাবিয়া নামক স্থানে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এক ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের যে কুরআন (ইলমে কিরাত) সম্পর্কে জানতে চায়, সে যেন হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.)-এর কাছে যায়। ফরাইয সম্পর্কে জানতে চাইলে যেন হযরত যায়দ বিন সাবিত (রা.)-এর কাছে যায়। ফিক্হ সম্পর্কে জানতে চাইলে মুআয বিন জাবাল (রা.)-এর কাছে যায়। আর অর্থ সম্পর্কিত কিছু জানতে চাইলে আমার কাছে আসবে। কারণ আল্লাহ আমাকে সম্পদের ওয়ালী ও বন্টনকারী করেছেন।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায়, যে যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়ে তার তাকলীদ করা যাবে।
২। ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রা.)-এর হাদীস:
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ الرَّجُلِ يَكُونُ لَهُ الدَّيْنُ عَلَى الرَّجُلِ إِلَى أَجَلٍ فَيَضَعُ عَنْهُ صَاحِبُ الْحَقِّ وَيُعَجِّلُهُ الْآخَرُ فَكَرِهَ ذَلِكَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ وَنَهَى عَنْه.
অর্থাৎ হযরত সালিম বিন আব্দুল্লাহ (র.) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণনা করেন- তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে যে অন্য এক জনের কাছে মেয়াদী ঋণে পাওনাদার ছিল। এখন সে মেয়াদের পূর্বে পরিশোধের শর্তে কিছু ছাড় দিতে রাজী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তা অপছন্দ করলেন এবং এরূপ করতে নিষেধ করলেন। (মুসনাদে ইমাম মালিক)
উক্ত হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) নিজের কথার সমর্থনে কোন আয়াত বা মারফু হাদীস উল্লেখ করেননি। সুতরাং বুঝা যায় এটা তার নিজস্ব ইজতিহাদ। আর প্রশ্নকর্তা তাঁর ইজতিহাদী ফতওয়াকে দলীল-প্রমাণ তলব ছাড়াই মেনে নেন।
৩। হযরত সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রা.) মসজিদে নামায আদায় করলে রুকু, সিজদা ও সালাত সংক্ষিপ্ত অথচ পরিপূর্ণরূপে করতেন। কিন্তু বাড়িতে নামায আদায় করলে তা দীর্ঘ করে আদায় করতেন। তাঁর ছেলে হযরত মুসআব (রা.) এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন-
يَا بُنَي ، إِنَّا أَئِمَّةٌ يُقْتَدَى بِنَا. (إتحاف الخيرة المهرة ، مُصنف ابن أبي شيبة)
অর্থাৎ হে আমার বৎস! আমরা হলাম ইমাম, আমাদের অনুসরণ করা হয়।
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় হযরত সা’দ (রা.)-এর নামায দীর্ঘ হলে তা দেখে লোকেরা মনে করবে এরূপ করা জরুরী এবং তারা তাঁকে দলীল জিজ্ঞেস না করেই আমল শুরু করে দিবে, যা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
৪। ইহরাম অবস্থায় হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.)-এর গায়ে রঙ্গীন কাপড় দেখে হযরত উমর (রা.) তাঁকে এরূপ কাপড় পরিধানের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হযরত তালহা (রা.) জবাব দিলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, এ রং-এ ঘ্রাণ নেই। আর ঘ্রাণ না থাকলে রঙ্গীন কাপড় পরিধান করতে কোন বাঁধা নেই।  জবাবে হযরত উমর (রা.) বলেন-
إِنَّكُمْ أَيُّهَا الرَّهْطُ أَئِمَّةٌ يَقْتَدِى بِكُمُ النَّاسُ فَلَوْ أَنَّ رَجُلاً جَاهِلاً رَأَى هَذَا الثَّوْبَ لَقَالَ : إِنَّ طَلْحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ قَدْ كَانَ يَلْبَسُ الثِّيَابَ الْمُصْبَغَةَ فِى الإِحْرَامِ فَلاَ تَلْبَسُوا أَيُّهَا الرَّهْطُ شَيْئًا مِنْ هَذِهِ الثِّيَابِ الْمُصْبَغَةِ. (موطأ الإمام مالك)
অর্থাৎ আপনারা হলেন ইমাম। লোকজন আপনাদের অনুসরণ করে। যদি কোন অজ্ঞ লোক এ পোশাক দেখে তা হলে বলবে, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.) ইহরাম অবস্থায় রঙ্গীন কাপড় পরিধান করতেন। সুতরাং আপনারা এরূপ রঙ্গীন কাপড় পরিধান করবেন না।
০৫। হযরত আম্মার বিন ইয়াসির ও আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-কে হযরত উমর (রা.) কুফায় প্রেরণ করেন। তাদের সাথে কুফাবাসীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দেন। চিঠির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:
إني قد بعثت إليكم بعمار بن ياسر أميرا وابن مسعود معلما ووزيرا وهما من النجباء من أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم فاقتدوا بهما واسمعوا من قولهما. (تاريخ مدينة دمشق وذكر فضلها)
-আমি তোমাদের কাছে আম্মার বিন ইয়াসির (রা.)-কে আমির এবং আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-কে শিক্ষক ও ওযীর হিসেবে পাঠালাম। তাঁরা দু’জনই হলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশিষ্ট দুই বদরী সাহাবী। সুতরাং তাঁদের ইকতিদা করবে ও যাবতীয় নির্দেশ মেনে চলবে।
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের যুগে তাকলীদ প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল। এমনকি স্বয়ং দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবীকে অনুসরণের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছেন। যদি তাকলীদ বৈধ না হতো তাহলে উমর (রা.) এরূপ ঘোষণা দিতেন না। এমনিভাবে সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর যুগ থেকে তাবিঈ, তাবে তাবিঈনের যুগ ধরে সর্বযুগে তাকলীদ চলে আসছে। সুতরাং তাকলীদ শিরক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না বরং তা জরুরী, বিশেষ করে গায়র মুজতাহিদ আলিমের জন্য তা অপরিহার্য।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু লোক নিজেদেরকে সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী মনে করে বলতে থাকে- শরীআতের মূলনীতি হল কুরআন ও হাদীস। এর বাইরে কোন কিছু মানা যাবে না। তারা কোন ইমামের অনুসরণ বা তাকলীদকে র্শিক বলতে শুরু করলো। তাদের কেউ কেউ আবার সহীহ হাদীস অনুসরণের কথা বলে কেবল বুখারী শরীফে সংকলিত হাদীসের উপর আমল করতেই বেশি আগ্রহী। অথচ বাস্তবে দেখা যায় বুখারী শরীফের অনেক হাদীসের উপরও তাঁদের আমল নেই। ইমাম বুখারী (র.)-এর মতের সাথে তাদের মতামতের কোন মিল নেই। এমনকি পরবর্তী যুগের গায়র মুকল্লিদগণ তাদের পূর্বসূরীদের অনেকের মতামতকে অশালীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেন, অথচ হাদীসের কিতাব বলতে তারা বুঝেন কেবল বুখারী ও কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিম শরীফ। এছাড়া হাদীসের কিতাবকে তারা আমলে আনেন না। তাদের এ আচরণ স্ববিরোধী ও ভ্রান্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
[সূত্র : তাকলীদ-এর সুদৃঢ় রজ্জু]

বুধবার, ১১ মার্চ, ২০১৫

নজরুলীয় দুর্বিনয় : শেষ কোথায়?


মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান


“বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির”
নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গগনবিদারী উচ্চারণ আর জাগরণের মন্ত্রে দীপ্ত বিদ্রোহের এ গানটি লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই তিনি বিদ্রোহী কবি। তাঁর সাহিত্য বিচারে কেউ তাঁকে বলেছের সাম্যের কবি, কেউ বলেছেন মানুষের কবি, মানবতার কবি। কেউ বলেছেন প্রেমের কবি আবার কেউ বলেছেন ইসলামী রেনেসাঁ বা জাগরণের কবি। মূলত তিনি একই সঙ্গে সকল অভিধায় অভিষিক্ত হবার পূর্ণ দাবি রাখেন। তাঁর কাব্য বিচার-বিশ্লেষণে যে কেউই এটা স্বীকার করবেন।
আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে কবি নজরুল এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। যেহেতু সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অনিশ্চিত, বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল পরিবেশের সাক্ষী হয়ে কবি প্রতিভার সূত্রপাত সেহেতু তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘশ্বাস, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ট বিদ্রোহ। বঞ্চিতের প্রতি নিবিড় সহানুভূতি নিয়ে কবির চেতনার গভীরে যে ক্ষোভ অসহনীয় উত্তাপে ফুটে উঠেছিল তা প্রকাশের তীব্র আকুতিই তাঁর কাব্য প্রেরণার মূল উৎস। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আরো বঞ্চিত করে বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ করে যে আইন, কবি ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি ঘোষণা করেন :
“আমি দূর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল
আমি দলে যাই যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।”
মূলত কবির বিদ্রোহী উচ্চারণ শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিবাদ। এ সংগ্রামী প্রতিবাদ থেকে কবি তখনই শান্ত হবেন যখন অবসান ঘটবে  সকল অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার। কবির ভাষায় :
“আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়নের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।”
কবি নজরুলের প্রতিবাদী এমন অনেক কবিতা পড়ে তাঁকে কেউ কেউ ‘বেপরোয়া’ ভাবলেও তাঁর এ বেপরোয়া বিচরণের একটি সীমারেখা আছে। এ সীমারেখা চিহ্নিত করেছেন প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ইসহাক সিদ্দীকী তার ‘নজরুলীয় দুর্বিনয় : মনস্তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ নামক এক প্রবন্ধে এভাবে- “কিন্তু আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দটির সাথে সাথে নজরুলীয় ঔদ্ধত্য লিপ্ত হয়নি কখনো তাঁর কবিতা কিংবা গানে। অথচ তাঁর ইসলামী ও মরমী রচনাবলীতে এ শব্দের রয়েছে সুনির্মল, ¯িœগ্ধ ও পরম সম্মানিত স্থান, যা সমস্ত ক্রোধ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, ঘৃণা ও স্বেচ্ছাচারের উর্ধ্বে। আমরা জানি, কাল-পাত্র নির্বিশেষে মুসলিম মানসে আল্লাহ নামের যে অনন্য মাহাত্ম্য ও ব্যঞ্জনা এর বিকল্প পরমার্থিক অন্য কোনো নামে নেই, বিভাষা তো দূরের কথা। এ দিক থেকে দেখতে গেলে পরম সত্তার নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী সেই জন্মগত ভেদজ্ঞান চরম দুর্বিনয় প্রকাশের কালেও নজরুলকে রেখেছিল সুরক্ষিত ও সচেতন।”
কাজী নজরুল ইসলাম স্বীয় বক্তব্যেও আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন তাঁর বক্তব্যে আছে :
১. আল্লাহ আমার প্রভূ। রাসুলের আমি উম্মত, আল কোরআন আমার পথপ্রদর্শক।
২. বিদ্বেষ আমার ধর্মবিরুদ্ধ। আমার আল্লাহ নিত্য পূর্ণ পরম অভেদ্য, নিত্য পরম প্রেমময়, নিত্য সর্বদ্বন্ধাতীত। কোনো ধর্ম, কোনো জাতি বা মানবের প্রতি বিদ্বেষ আমার ধর্মে নাই, কর্মে নাই, মর্মে নাই। মানুষের বিচারকে আমি স্বীকার করি না, ভয়ও করি না। আমি একমাত্র পরম বিচারক আল্লাহ ও তাঁর বিচারকে জানি। (আমার লীগ কংগ্রেস)
কবি স্বীয় কবিত্বশক্তিকেও আল্লাহর দান হিসেবে স্বীকার করে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। তিনি বলেছেন : আমার কবিতা আমার শক্তি নয়, আল্লাহর দেওয়া শক্তি। আমি উপলক্ষ মাত্র। বীণার বেণুতে সুর বাজে, কিন্তু বাজান যে গুণী সকল প্রশংসা তাঁরই।
অসংখ্য কবিতা ও গানেও কবি আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং তাঁরই হামদ গেয়েছেন। সর্বোপরি সকল হিংসা-বিদ্বেষ ও স্বেচ্ছাচারিতার উর্ধ্বে এক আল্লাহতে আত্মনিবেদন করত তাঁর উপর তাওয়াক্কুল তথা পূর্ণ ভরসা রেখেছেন। কবি দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করেন :
“উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।”

শেষ কথা হলো, কবি নজরুল স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের শাসন-শোষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন। তাই তাঁর অনেক কবিতা ও গানে দ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছে, চরম দুর্বিনয় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা ও বক্তব্যে। কিন্তু এ দুর্বিনয় ও বেপরোয়া বিচরণ আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দের সাথে লিপ্ত হয়নি। মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থা।

শনিবার, ৭ মার্চ, ২০১৫

তাঁর চেহারা ছিল জ্যোতির্ময়


মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
রাসূলে আরাবী (সা.)-এর চেহারার বর্ণনায় বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবীয়ে আকরাম (সা.) এর চেহারা পৃথিবীর সকল মানুষ থেকে অধিক সুন্দর ছিল। তার সেই নূরানী চেহারাতে যেন সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হতো। (তিরমিযী)
মহান আল্লাহ তা‘আলা হলেন সকল সুন্দর্যের আধার। আল্লাহ নিজে সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। সকল রূপ-সৌন্দর্যের ¯্রষ্টা, যিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন তিনি তার হাবীবকে কেমন সুন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? কেমন রূপের বাহার ছিল তার মাহবূবের চেহারাতে? হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আমি ছিলাম গুপ্ত ভান্ডার। আমি ইচ্ছা করলাম প্রকাশিত হওয়ার, আর সে জন্যে আমি এক মাখলূক সৃষ্টি করলাম যার নাম দিলাম মুহাম্মদ (সা.)।
মহান আল্লাহ তার যাত-সিফাত, জামাল-কামাল কে প্রকাশিত করার জন্যে মুহাম্মদ (সা.) কে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মহান আল্লাহর সেই জামাল কেমন রূপে তার হাবীবের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল?
ইবনে আসাকির জাবির (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- আমার কাছে জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন আল্লাহ পাক আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আর বলেছেন- হে আমার হাবীব! আমি নবী ইউসুফ (আ.) কে আমার কুরসীর নূর দ্বারা সুন্দরর্যমন্ডিত করেছি। আর আপনার চেহরায়ে আনওয়ারে আমার আরশের নূর প্রদান কিেছ। (খাসায়িসুল কুবরা)
হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন-
لواحي زليخا لو رأين جبينه + لأثرن بالتقطيع الصدور علي اليد
-যদি যুলায়খার সঙ্গী-সাথীরা আমার নবীর নূরানী চেহারা দেখত, তাহলে তাদের নিজ হাতে তাদের কলিজা কেটে দিত। (খাসায়িস)
প্রিয় নবীর একান্ত সহচর গারে সূরের সাথী হযরত আবূ বকর (রা.) বলেন-
كان وجه رسول الله صلي الله عليه وسلم كأنه دارة
-রাসূল (সা.)-এর চেহারা যেন একরাশ তারকার ন্যায় ছিল।
নূরে মুজাস্সাম হাবীবে কিবরিয়া (সা.)-এর চেহারার সুন্দর্য সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা হলো- তার চেহারা ছিল উজ্জলতম, পুষ্পিত আলোকময়, দৃশ্যমান এক জ্যোতি, পূর্ণিমার রাতের আলার ন্যায় ঝলমলে। হযরত জাবির (রা.) এক পূর্ণিমার রজনীতে রাসূল (সা.) এর চেহারার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলেন আমি একবার প্রিয়নবীর চেহারার দিকে তাকাই আরেকবার আকাশের চন্দ্রের দিকে তাকাই। অবশেষে আমি এটা নিশ্চিত হলাম যে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দর।
অন্ধকার আলোতে প্রিয়নবীর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন-
আমি রাতের বেলা সেলাই করছিলাম। হঠ্যাৎ আমার হাত থেকে সূঁই পড়ে গেল। অনেক খোঁজাখোঁজি করেও সুঁই পাইনি। এমন সময় রাসূল (সা.) আমার ঘরে তাশরীফ আনেন। তার আলোকোজ্জল চেহারার আলোতে আমি আমার সুঁই পেয়ে যাই।
আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (সা.)-এর মধ্যে জাহেরী-বাতেনী সকল ধরনের সৌন্দর্যের সমাহার ঘটিয়েছেন, যা পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত কারো মধ্যে ঘটান নি। তার মধ্যে বাতেনী সুন্দর্যের মতো জাহেরী সুন্দের্যের অনন্য সমাহার ছিল। প্রিয়নবীর সেই জাহেরী সুন্দর্য দেখে অসংখ্য কাফের মুসলমান হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-এর জাহেরী সুন্দর্য চর্মচক্ষে অবলোকন করেছেন। যার জন্য তারা রাসূল (সা.)-এর পদ্বতলে তাদের জীবন কুরবান করে দিয়েছেন। এমনকি উদ্ভিদ-প্রাণীরাও তার ভালোবাসায় প্রাণ উৎসর্গ করেছে। বিদায় হজ্জের দিন রাসূল (সা.) ৬৩ টি কুরবানী নিজ হাতে দিয়েছেন। কুরবানীর উটগুলো রাসূল (সা.)-এর প্রিয় হাতে তাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, কার আগে কে কুরবানী হবে। প্রিয়নবীর ইন্তেকালের পর তার নূরানী চেহারার দর্শন না পেয়ে বেদনায় তার গাধাটি কূপের মধ্যে পড়ে প্রাণ দিয়ে দেয়। রাসূল (সা.)-এর উষ্ট্রি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। অবশেষে মারা যায়।
কি অলৌকিক আকর্ষন ছিল তার চেহারায়? ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে সাহাবায়ে কিরাম তার মজলিসে বসতেন। নবীজীর নূরানী চেহারার দিকে তাকিয়ে তারা তাদের ক্ষুধাকে নিভৃত করতেন। শত দুঃখ, কষ্ঠ, যন্ত্রনা দূর করতেন। এক মহিলা সাহাবীর স্বামী, দুই সন্তান জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তিনি সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। তিনি বার বার বলতেছিলেন আমার নবীর অবস্থা কি? তিনি কেমন আছেন? (সুবহানাল্লাহ)
রাবী‘ বিনতে মুআওয়িয বলেন- لو رأيته لرأيت الشمس طالعة
-আমি যখন রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকাতাম তখন মনে হতো যেন উদিত সূর্যের দিকে তাকাচ্ছি। (তিরমিযী)
হযরত আবূ তোফায়ল (রা.) বলেন-
كان أبيض مليح الوجه مرأة وكأن البدر يري في وجهه.
-রাসূল (সা.) ছিলেন শুভ্র এবং লাবন্যময় চেহারার অধিকারী। তিনি যখন আনন্দিত হতেন তখন তার চেহারায় যেন পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যেত। (মুসলিম)
হাবীবে খোদার জামাল-কামালের সরাসরি প্রত্যক্ষকারী সাহাবায়ে কেরাম তাদের কবিতায় নবীর সৌন্দর্যের অতুলনীয় বিবরণ দিয়েছেন।
নবীয় আকরাম (সা.)-এর সুন্দর্যের বর্ণনায় হযরত হাসসান বিন ছাবিত (রা.) বলেন-
أحسن منك لم تري قط عين + وأجمل منك لم تلد النساء
-আপনার চেয়ে সুন্দর কোন মানুষ আমার চোখ দেখেনি, আর আপনার চেয়ে অধিক সুন্দর শিশু কোন নারী জন্ম দেয়নি।
হযরত কা’ব বিন যুহায়র (রা.) বলেন-
إن الرسول لنور يستضاء به + مهند من سيوف الله مسلول
-নিশ্চয়ই রাসূল (সা.) হলেন নূর, তার থেকে সবি আলোকিত হয়। তিনি আল্লাহর ধারালো তরবারী।
হযরত হাসান ইবনু আলী (রা.) বলেন-
فخما مفخما يتلألأ وجهه صلي الله عليه وسلم تلألؤ القمر ليلة البدر
-রাসূল (সা.) ছিলেন সম্মান ও মর্যাদার আধাঁর, পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ন্যায় তার চেহারা থেকে নূর বিচ্ছূরিত হতো।
জনৈকা মহিলা নবীজীর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- তার চেহারা ছিল পূর্ণিমার রজনীর চাঁদের ন্যায়। আমি ইতোপূর্বে তার মতো কাউকে দেখিনি, পরেও দেখিনি। (তিরমিযী)
হযরত আয়শা (রা.) বলেন-
إذا سر تبرق أسارير وجهه كأنه قطعة قمر
রাসূল (সা.) যখন আনন্দিত হতেন তখন তার চেহারা অধিক উজ্জল হতো, দেখলে মনে হতো যেন নক্ষত্রের এক টুকরো।
নবীজীর সৌন্দর্যের বর্ণনায় উম্মে মা’বাদ (রা.) বলেন-
এসেছিলেন মোদের ঘরে এক মোবারক মেহমান
এসেছিলেন খিমায় মোদের রূপ জগতের রাজ কুমার
লাবণ্যময় স্বর্ণ উজাল মধ্য তনুকান্তি তাঁর
সতেজ সুঠাম শোভন দেহ প্রশস্ত স্কন্ধদ্বয়
যুক্ত ভুরু গ্রীবা দীঘল চওড়া ললাট জ্যোতির্ময়
সরল সোজা উচ্চনাতি টিকালো নাক মন মোহন
গোলাপ রাঙা অধর যুগল টশটশে বেশ সুদর্শন
মুন্ড সুগোল দর্শনীয় বিনয়নত উচ্চশির
চিত্তহারি কুসুম কোমল অঙ্গে সুবাস কস্তুরির।
(কাব্যানুবাদ: কবি রূহুল আমীন খান)

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা

মুফতী মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
কুরআন, সুন্নাহ এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সংঘটিত ইজমা ও কিয়াস-এ চারটি মূলনীতি হচ্ছে দীন ও শরীআতের যাবতীয় বিধি বিধানের মাপকাঠি। কিন্তু কুরআন সুন্নাহতে বর্ণিত আহকামসমূহের প্রত্যেকটি সমান নয়। কিছু কিছু আহকাম হচ্ছে স্পষ্ট ও বিরোধমুক্ত। যেমন নামায ফরয হওয়া, রোযা ফরয হওয়া, হজ্জ ফরয হওয়া, যিনা নিষিদ্ধ হওয়া, মদ খাওয়া ও চুরি করা নিষিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। এগুলোর উপর আমলের জন্য কোন প্রকার চিন্তা গবেষণার প্রয়োজন নেই।
পক্ষান্তরে কিছু কিছু আহকাম হচ্ছে এমন যে, এগুলো সম্পর্কে বর্ণিত আয়াত বা হাদীস অস্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত বা আপাত:দৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ। যেমন- আল্লাহ তা’আলার বাণী: وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ আলোচ্য আয়াতে قُرُوءٍ শব্দটি দুইটি অর্থে মুশতারাক। একটি হলো حيض (ঋতুস্রাব), অপরটি হলো طهر (পবিত্রতা)। সুতরাং এখানে শব্দটি কোন অর্থে গৃহীত হবে সে বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন আছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস:
مَنْ لم يترك المخابرة فليأذَن بِحَرب من الله ورسوله. (جامع الأصول في أحاديث الرسول)
অর্থাৎ যে মুখাবারা বা বর্গা ব্যবস্থা পরিহার করে না সে যেন আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধে নামার ঝুঁকি নেয়।
এ হাদীস থেকে আমভাবে বর্গা প্রথা নিষিদ্ধ বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু সকল বর্গাই নিষিদ্ধ নাকি এর বিশেষ কোন প্রকার নিষিদ্ধ তা এখানে সুস্পষ্ট নয়।
অন্য হাদীসে আছে-  مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ . (إتحاف الخيرة المهرة) অর্থাৎ যে ইমামের পেছনে নামায পড়বে, ইমামের কিরাত তার জন্য যথেষ্ট হবে। অপরদিকে অন্য হাদীসে এসেছে-
لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ. (إتحاف الخيرة المهرة)
অর্থাৎ যে সূরা ফাতিহা পড়েনি তার নামায শুদ্ধ হয়নি।
আলোচ্য হাদীসদ্বয় আপাতদৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ হওয়ায় কোন হাদীসের উপর আমল করা যাবে তা স্পষ্ট নয় এবং স্বাভাবিক ইলম দ্বারা তা বুঝাও সম্ভব নয়।
এ ধরণের জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে আমলের জন্য দুটি পথ। প্রথমত: নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করে ফয়সালা করা। দ্বিতীয়ত: এ ব্যাপারে পূর্বসূরীগণের প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের আলোকে আমল করা। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পথই সাধারণ মানুষ ও অমুজতাহিদ আলিমের জন্য অপরিহার্য। তা না হলে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর এরূপ মাসআলায় নির্দ্বিধায় কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করার নামই হচ্ছে তাকলীদ।
জটিল মাসআলায় সাধারণ লোকদের তাকলীদ ছাড়া কোন পথই নেই। তাদেরকে পূর্বসূরী প্রজ্ঞাশীল কোন মুজতাহিদকে অনুসরণ করতেই হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এরূপ তাকলীদের সরাসরি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কুরআন মজীদে তাকলীদের দলীল
১। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ .
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলুল আমর এর আনুগত্য কর। (সূরা নিসা- ৫৯)
উক্ত আয়াতেأُولِي الْأَمْرِ  বলতে কারা- এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কিরাম প্রায় সকলেই বলেছেন, এরা হলেন কুরআন সুন্নাহ’র ইলমের অধিকারী ফকীহ ও মুজতাহিদগণ।
২। পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে আছে-
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ .
অর্থাৎ যখন তাদের কাছে শান্তি অথবা ভীতি সংক্রান্ত কোন সংবাদ আসে, তখন তারা তা প্রচারে লেগে যায়। অথচ যদি (তারা তা না করে) বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর এর কাছে ছেড়ে দিত, তাহলে ইস্তিম্বাতে পারদর্শী তথা সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারীগণ এর রহস্য উদঘাটন করতে পারতেন। (সূরা নিসা- ৮৩)
উক্ত আয়াত যুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হলেও একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, পবিত্র কুরআনের কোন আয়াতের শানে নুযুল খাস হলেও এর উপর আমল আম। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন জটিল বিষয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে বিজ্ঞ লোকদের প্রজ্ঞাশীল সিদ্ধান্তের অনুসরণ ও তাকলীদ করা আবশ্যক।
৩। অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
Ñপ্রত্যেক দল থেকে এক একটি ছোট দল ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন বেরিয়ে পড়ে না, যাতে তারা যখন তাদের কওমের কাছে ফিরে আসবে তখন তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করবে, যেন তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবাহ- ১২২)
উক্ত আয়াতে ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য একদল লোককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর কওমের বাকী লোক যারা এ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভ করতে পারেনি তাদেরকে ঐ ফকীহদের আনুগত্য বা তাকলীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৪। আল্লাহ তাআলার বাণী- فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ অর্থাৎ তোমরা যদি না জান তাহলে আহলে ইলমদের কাছ থেকে জেনে নাও। (সূরা নহল- ৪৩, আম্বিয়া- ০৭)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ সকলকে কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি ফতওয়া বের করার নির্দেশ না দিয়ে বরং কুরআন হাদীসের ইলমে পারদর্শী লোকদের কাছ থেকে অজ্ঞ লোকদের জেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাকলীদের মূল কথাও হলো তাই।

হাদীস শরীফ থেকে তাকলীদের দলীল
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদীস থেকে অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞ আলিমের কাছে ফতওয়া তলব ও তদনুযায়ী আমল করার নির্দেশ ও প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
০১। হাদীস শরীফে আছে-
عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جُلُوسًا فَقَالَ إِنِّي لَا أَدْرِي مَا قَدْرُ بَقَائِي فِيكُمْ فَاقْتَدُوا بِالَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي وَأَشَارَ إِلَى أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ.
-হযরত হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- জানি না আমি আর কতদিন তোমাদের মধ্যে থাকব। সুতরাং তোমরা আমার পরবর্তীদের অনুসরণ করবে। একথা বলে তিনি আবূ বকর ও উমর (রা.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে ইমাম আহমদ)
উক্ত হাদীসে ‘ইকতিদা’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যার অর্থ শরীআতের বিষয়সমূহে কেউ কারো অনুসরণ করা।
০২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أُفْتِىَ بِغَيْرِ عِلْمٍ كَانَ إِثْمُهُ عَلَى مَنْ أَفْتَاهُ.
অর্থাৎ যে না জেনে ফতওয়া প্রদান করবে, এর পাপ ফতওয়াদাতার উপরই পতিত হবে।
লক্ষ্যণীয় যে, এখানে ফতওয়ার দায়-দায়িত্ব ফতওয়াদাতার উপর চাপানো হয়েছে। কিন্তু তার ফতওয়া অনুযায়ী যারা আমল করেছেন তাদেরকে দোষারোপ করা হয়নি। আবার অনুসরণকারীদেরকে যাচাই বাছাই করে ফতওয়া গ্রহণের নির্দেশও দেয়া হয়নি। এরূপ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফতওয়াদাতা ও আমলকারী উভয়কে সমানভাবে দোষারোপ করতেন। এতে বুঝা যায় একদল লোক কেবল তাকলীদ করবেন এবং তাদের তাকলীদ করা শুদ্ধ হবে।
০৩। কোন কোন সাহাবী নামাযের জামাতে দেরিতে এসে পেছনে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে প্রথমে এসে প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর তাকীদ দিয়ে ইরশাদ করেন-
ائْتَمُّوا بِي وَلْيَأْتَمَّ بِكُمْ مَنْ بَعْدَكُمْ
অর্থাৎ তোমরা আমার অনুসরণ কর আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদের অনুসরণ করবে।
[সূত্র : মুফতী মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী কৃত ‘তাকলীদের সুদৃঢ় রজ্জু’]

বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫

তাকলীদ ও আহলে হাদীস

মাহমুদুল হাসান
তাকলীদ এর আভিধানিক অর্থ গলায় হার পরানো শরীআতের পরিভাষায় তাকলীদ হলো নির্ভরযোগ্য আলিম এর মতামতকে সঠিক জেনে দলীল তলব না করে মানার নাম তাকলীদ
দলীল-প্রমাণ না চেয়ে আলিমের রায় মেনে নেওয়াই হলো তাকলীদসালাফে সালেহীন তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামোয়ে কিরাম যুগ যুগ ধরে আইম্মায়ে আরবাআ (ইমাম আবূ হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল) এর কোন কোন এক ইমামের তাকলীদ করে আসছেন এমনকি নব্যপ্রসূত লা-মাযহাবীরা হাদীসের ক্ষেত্রে যে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করে তিনিও তাকলীদে বিশ্বাস করতেন এবং মানতেনতার ছাত্র ইবনু কাইয়িম আল জাওযিয়্যাহও মাযহাব মানতেনইবনু তাইমিয়ার মাযহাব সম্পর্কে আহলে হাদীসদের অন্যতম আলেম সিদ্দিক হাসান তাঁর আল-জুন্নাহকিতাবের ৩৮ পৃষ্টায় বলেন- শায়খূল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেনতার ছাত্র ইবনু কাইয়িমও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন
ইবনু তাইমিয়া এবং ইবনু কাইয়িম আল জাওযিয়্যাহ এর মাযহাব হাম্বলী হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাইতাঁর লিখিত মাজমুআতুল ফাতাওয়াএর প্রমাণ বহন করে
প্রশ্ন হলো তাকলীদের ক্ষেত্রে কেন দলীল চাওয়ার প্রয়োজন নেই? সহজ উত্তর- আল্লাহ তাআলা দলীল চাইতে বলেন নি তাই চাওয়া যাবে নাতাকলীদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে- فاسئلوا اهل الذكر إن كنتم لا تعلمون
অর্থ্যা- তোমরা যদি কোন বিষয়ে না জান তাহলে যারা জানে তাদের কাছে জেনে নাও
এই আয়াতে মহান আল্লাহ অজানা বিষয় জানার জন্য বলেছেন, তার জন্য দলীল বা প্রমাণ চাইতে বলেন নিপবিত্র হাদীস শরীফে আমরা উক্ত আয়াতের বাস্তব চিত্র খুজে পাইসাহাবায়ে কিরাম কোন অজানা বিষয়ে যিনি জানেন তাকে প্রশ্ন করলে তিনি যা বলতেন তাই মেনে নিতেনএর জন্য দলীল চাইতেন না
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) কে একবার দুই ব্যাক্তির ঋণ সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলো যে, প্রথমজন দ্বিতীয়জনের কাছে মেয়াদী ঋণের পাওনাদারমেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে ঋণ পরিশোধ করলে আংশিক ঋণ মওকূফে সম্মত হয়েছেএ ব্যাপারে শরীআতের নির্দেশ কি? হযতে উমর (রা.) তা নাকচ করে দিলেন
হযরত উমর (রা.) নিজ ইজতিহাদ থেকে এই মাসআলা দিয়েছেনসে জন্যে তিনি দলীল পেশ করারও প্রয়োজনবোধ করেননি, এমনকি প্রশ্ন কর্তাও দলীল জানতে চান নি বিনা দলীলে মেনে নিয়েছেনআর বিনা দলীলে মেনে নেওয়ার নামই হলো তাকলীদ
ফারায়যের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসআলা সম্পর্কে হযরত আলী (রা.) কে প্রশ্ন করা হলোতখন তিনি মিম্বরের উপর ছিলেনআলী (রা.) মিম্বরে বসে ফতওয়া দিলেন; তিনি কোন দলীল পেশ করেন নিপ্রশ্নকর্তাও ফতওয়ার পক্ষে কোন দলীল তলব করেননি
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে- জনৈক মহিলা সাহাবী রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে আরজ করলেন-ইয়া রাসূল্লাহ! আমার স্বামী জিহাদে গমন করেছেনতিনি থাকাবস্থায় আমি নামাযসহ অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করতামতিনি ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে এমন আমল শিখিয়ে দিন যা তার আমলের স্থলাভিষিক্ত হয়
দেখুন! মহিলা সাহাবী তার যাবতীয় আমলের ক্ষেত্রে তার স্বামীর ইকতিদা করেছেনরাসূল (সা.)ও তা সমর্থন করেছেন
শরীআত সকল মুসলমানদের উপর ফতওয়া প্রদানের দায়িত্ব দেয়নিএকমাত্র কুরআন-হাদীসে পারদর্শীগণ মাসআলা ইস্তিন্ব^াত করবেন, ফতওয়া দিবেনসাধারণ মুসলমান দলীল না চেয়ে তাদের কথা মেনে নিবেনএ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا في الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থা- দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রত্যেক দল থেকে একটি উপদল কেন বেরিয়ে পড়ে না, যেন ফিরে এসে ম্বজাতিকে তারা সতর্ক করতে পারে?
এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের কিছু অংশকে দ্বীনী শিক্ষায় পান্ডিত্য অর্জনের কথা বলেছেনযারা শিক্ষা অর্জন করে অবশিষ্ঠ্য মুসলমান; যারা দ্বীনী শিক্ষায় পান্ডিত্য অর্জন করেনি তথা সাধারণ মুসলমানদেরকে নসীহত করবে এবং সাধারণ মুসলমান তাদের কথা মেনে চলবে
মহান আল্লাহ মুসলমানদের সার্বিক সুবিধার জন্যে এই নির্দেশ দিয়েছেনকারণ দ্বীনী বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়পক্ষান্তরে আহলে হাদীসরা মহান আল্লাহর এই সহজ বিধানকে কঠিন থেকে কঠিনতর করার জন্যে বলে যে সকল মুসলমানের জন্য কুরআন-হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতে হবে
ইসলামের সকল যুগেই দুধরনের মুসলমান ছিলেনআম এবং খাসমুসলমানদের এক অংশ দ্বীনী বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখতেন, ইজতিহাদ করতেন এবং সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেনআর অপর পক্ষ তাদের কথা মেনে নিয়ে আমল করতেনযেমন
হযরত আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রা.) বিশেষ একপ্রকার মোজা পরতে দেখে উমর (রা.) বলেছিলেন- তোমাকে কসম দিয়ে বলছি তুমি মোজা জোড়া খুলে ফেলকারণ আমি আশঙ্কা করি সাধারণ লোকজন তোমাকে দেখে তোমার ইকতিদা করবে
হযতে তালহা (রা.) এর গায়ে রঙ্গিন ইহরাম দেখে হযরত উমর (রা.) বললেন এটা কেন পড়েছে? তালহা (রা.) বললেন এটাতে তো সুগন্ধি নাইউমর (রা.) বললেন- শুন! তোমরা হলে ইমামসাধারণ লোকজন তোমাদের ইকতদা করেকোন অজ্ঞ লোক তোমার এই কাপড় দেখলে বলবে তালহা ইবনু উবায়দুল্লাহ ইহােম হিসাবে রঙ্গিন কাপড় পড়তেন (না বুঝে সুগন্ধযুক্ত এবং সুগন্ধহীন উভয় কাপড় পড়া শুরু করবে)সুতরায় তোমরা এমন কাপড় পড়ো না
ইসলামের প্রতিটি যুগে সাধারণ মুসলমানদের বিরাট একটি অংশ ছিলযারা উলামায়ে কেরামের কথা, উক্তি এবং তাদের দেখানো আমল আদর্শ হিসাবে মানতেন এবং তাকলীদ বা অনুসরণ করতেনকারণ তারা বিশ্বাস করতেন উলামায়ে কিরাম যে ফতওয়া বা আদর্শ আমাদেরকে দিচ্ছেন সেটা অবশ্যই কুরআন এবং হাদীস গবেষণা করেই দিচ্ছেনএই গবেষনার নাম হচ্ছে ইজতিহাদ
আহলে হাদীসরা মুসলমানদেরকে তাদের পূর্বসুরীদের পথ এবং মত থেকে সরিয়ে দাজ্জালী ফিতনার মুখোমুখি করার প্রয়াস চালাচ্ছেতারা সরলমনা মুসলমানদের ধোকা দেওয়ার জন্য বলে পূর্বসুরীদের পথ আকড়ে ধরা হলো কাফিরদের স্বভাবঅথচ কুরআন শরীফে আল্লাহ তালা মুনাফিকদের বৈশিষ্ঠ সম্পর্কে বলেন আর তারা মুমিনদের (রেখে যাওয়া) পথ ছেড়ে অন্য পথের অনুসরণ করে
লা-মাযহাবীরা মুখে যতই বলুক যে তারা তাকলীদ করে না কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিটি কাজ-কর্মই তাকলীদ অনুযায়ী হচ্ছেযেমন, আমরা জানি কুরআন শরীফ সাত কিরাআতে নাযিল হয়েছে বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত প্রচলিত আছেবিশ্বের সকল মুসলমান এ ক্ষেত্রে ইমাম হাফস (র.)-এর তাকলীদ করেনআহলে হাদীস, লা-মাযহাবী, সালাফীরাও ইমাম হাফসের কিরাআতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেন; এত তারা ইমাম হাফস (র.)-এর তাকলীদ করল

আহলে হাদীসের প্রতি কিছু প্রশ্ন
আহলে হাদীসরা মাযহাব পন্থী লোকদের ধোকা দেওয়ার জন্য দসব সময় বলে থাকেন কুরআন এবং সহীহ হাদীসে আছে কি না? সে জন্যে নিচে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হলো, আহলে হাদীস ভাইগণ উত্তর দিবেন
নামাযসহ শরীআতের বিভিন্ন হুকুম-আহকামে যে সমস্ত ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাব ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে সেগুলো প্রমাণ করুন
হাদীস শরীফে মানুষের ছবির ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা এসেছেতারপরও আহলে হাদীস ভাইয়েরা টি.ভি তে অনুষ্ঠান করেন কোন আয়াত এবং সহীহ হাদীসের আলোকে?
পবিত্র হাদীস অনুযায়ী ছবি তোলা হারামতাহলে হজ্জের জন্য ছবি তুলা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণ পেশ করুন
পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) কোন কিরাত পড়তেন? ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত রাসূল (সা.)-এর কিরাত কি না? সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণ করুনযদি না হয় তাহলে আপনারা রাসূল (সা.) এর কিরাতে পড়েন না কেন?
মোবাইলে বা রেকর্ডে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা ওয়াজিব হবে কি না? কুরআন এবং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করুন

রাসূল (সা.)-এর যুগে হাদীস সংকলিত হয়েছিল কি না? সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ দিন