খাসাইস ও সীরাতে রাসূল (সা.)

তাঁর চেহারা ছিল জ্যোতির্ময়

মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
রাসূলে আরাবী (সা.)-এর চেহারার বর্ণনায় বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবীয়ে আকরাম (সা.) এর চেহারা পৃথিবীর সকল মানুষ থেকে অধিক সুন্দর ছিল। তার সেই নূরানী চেহারাতে যেন সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হতো। (তিরমিযী)
মহান আল্লাহ তা‘আলা হলেন সকল সুন্দর্যের আধার। আল্লাহ নিজে সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। সকল রূপ-সৌন্দর্যের ¯্রষ্টা, যিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন তিনি তার হাবীবকে কেমন সুন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? কেমন রূপের বাহার ছিল তার মাহবূবের চেহারাতে? হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আমি ছিলাম গুপ্ত ভান্ডার। আমি ইচ্ছা করলাম প্রকাশিত হওয়ার, আর সে জন্যে আমি এক মাখলূক সৃষ্টি করলাম যার নাম দিলাম মুহাম্মদ (সা.)।
মহান আল্লাহ তার যাত-সিফাত, জামাল-কামাল কে প্রকাশিত করার জন্যে মুহাম্মদ (সা.) কে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মহান আল্লাহর সেই জামাল কেমন রূপে তার হাবীবের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল?
ইবনে আসাকির জাবির (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- আমার কাছে জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন আল্লাহ পাক আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আর বলেছেন- হে আমার হাবীব! আমি নবী ইউসুফ (আ.) কে আমার কুরসীর নূর দ্বারা সুন্দরর্যমন্ডিত করেছি। আর আপনার চেহরায়ে আনওয়ারে আমার আরশের নূর প্রদান কিেছ। (খাসায়িসুল কুবরা)
হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন-
لواحي زليخا لو رأين جبينه + لأثرن بالتقطيع الصدور علي اليد
-যদি যুলায়খার সঙ্গী-সাথীরা আমার নবীর নূরানী চেহারা দেখত, তাহলে তাদের নিজ হাতে তাদের কলিজা কেটে দিত। (খাসায়িস)
প্রিয় নবীর একান্ত সহচর গারে সূরের সাথী হযরত আবূ বকর (রা.) বলেন-
كان وجه رسول الله صلي الله عليه وسلم كأنه دارة
-রাসূল (সা.)-এর চেহারা যেন একরাশ তারকার ন্যায় ছিল।
নূরে মুজাস্সাম হাবীবে কিবরিয়া (সা.)-এর চেহারার সুন্দর্য সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা হলো- তার চেহারা ছিল উজ্জলতম, পুষ্পিত আলোকময়, দৃশ্যমান এক জ্যোতি, পূর্ণিমার রাতের আলার ন্যায় ঝলমলে। হযরত জাবির (রা.) এক পূর্ণিমার রজনীতে রাসূল (সা.) এর চেহারার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলেন আমি একবার প্রিয়নবীর চেহারার দিকে তাকাই আরেকবার আকাশের চন্দ্রের দিকে তাকাই। অবশেষে আমি এটা নিশ্চিত হলাম যে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দর।
অন্ধকার আলোতে প্রিয়নবীর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন-
আমি রাতের বেলা সেলাই করছিলাম। হঠ্যাৎ আমার হাত থেকে সূঁই পড়ে গেল। অনেক খোঁজাখোঁজি করেও সুঁই পাইনি। এমন সময় রাসূল (সা.) আমার ঘরে তাশরীফ আনেন। তার আলোকোজ্জল চেহারার আলোতে আমি আমার সুঁই পেয়ে যাই।
আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (সা.)-এর মধ্যে জাহেরী-বাতেনী সকল ধরনের সৌন্দর্যের সমাহার ঘটিয়েছেন, যা পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত কারো মধ্যে ঘটান নি। তার মধ্যে বাতেনী সুন্দর্যের মতো জাহেরী সুন্দের্যের অনন্য সমাহার ছিল। প্রিয়নবীর সেই জাহেরী সুন্দর্য দেখে অসংখ্য কাফের মুসলমান হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-এর জাহেরী সুন্দর্য চর্মচক্ষে অবলোকন করেছেন। যার জন্য তারা রাসূল (সা.)-এর পদ্বতলে তাদের জীবন কুরবান করে দিয়েছেন। এমনকি উদ্ভিদ-প্রাণীরাও তার ভালোবাসায় প্রাণ উৎসর্গ করেছে। বিদায় হজ্জের দিন রাসূল (সা.) ৬৩ টি কুরবানী নিজ হাতে দিয়েছেন। কুরবানীর উটগুলো রাসূল (সা.)-এর প্রিয় হাতে তাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, কার আগে কে কুরবানী হবে। প্রিয়নবীর ইন্তেকালের পর তার নূরানী চেহারার দর্শন না পেয়ে বেদনায় তার গাধাটি কূপের মধ্যে পড়ে প্রাণ দিয়ে দেয়। রাসূল (সা.)-এর উষ্ট্রি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। অবশেষে মারা যায়।
কি অলৌকিক আকর্ষন ছিল তার চেহারায়? ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে সাহাবায়ে কিরাম তার মজলিসে বসতেন। নবীজীর নূরানী চেহারার দিকে তাকিয়ে তারা তাদের ক্ষুধাকে নিভৃত করতেন। শত দুঃখ, কষ্ঠ, যন্ত্রনা দূর করতেন। এক মহিলা সাহাবীর স্বামী, দুই সন্তান জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তিনি সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। তিনি বার বার বলতেছিলেন আমার নবীর অবস্থা কি? তিনি কেমন আছেন? (সুবহানাল্লাহ)
রাবী‘ বিনতে মুআওয়িয বলেন- لو رأيته لرأيت الشمس طالعة
-আমি যখন রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকাতাম তখন মনে হতো যেন উদিত সূর্যের দিকে তাকাচ্ছি। (তিরমিযী)
হযরত আবূ তোফায়ল (রা.) বলেন-
كان أبيض مليح الوجه مرأة وكأن البدر يري في وجهه.
-রাসূল (সা.) ছিলেন শুভ্র এবং লাবন্যময় চেহারার অধিকারী। তিনি যখন আনন্দিত হতেন তখন তার চেহারায় যেন পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যেত। (মুসলিম)
হাবীবে খোদার জামাল-কামালের সরাসরি প্রত্যক্ষকারী সাহাবায়ে কেরাম তাদের কবিতায় নবীর সৌন্দর্যের অতুলনীয় বিবরণ দিয়েছেন।
নবীয় আকরাম (সা.)-এর সুন্দর্যের বর্ণনায় হযরত হাসসান বিন ছাবিত (রা.) বলেন-
أحسن منك لم تري قط عين + وأجمل منك لم تلد النساء
-আপনার চেয়ে সুন্দর কোন মানুষ আমার চোখ দেখেনি, আর আপনার চেয়ে অধিক সুন্দর শিশু কোন নারী জন্ম দেয়নি।
হযরত কা’ব বিন যুহায়র (রা.) বলেন-
إن الرسول لنور يستضاء به + مهند من سيوف الله مسلول
-নিশ্চয়ই রাসূল (সা.) হলেন নূর, তার থেকে সবি আলোকিত হয়। তিনি আল্লাহর ধারালো তরবারী।
হযরত হাসান ইবনু আলী (রা.) বলেন-
فخما مفخما يتلألأ وجهه صلي الله عليه وسلم تلألؤ القمر ليلة البدر
-রাসূল (সা.) ছিলেন সম্মান ও মর্যাদার আধাঁর, পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ন্যায় তার চেহারা থেকে নূর বিচ্ছূরিত হতো।
জনৈকা মহিলা নবীজীর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- তার চেহারা ছিল পূর্ণিমার রজনীর চাঁদের ন্যায়। আমি ইতোপূর্বে তার মতো কাউকে দেখিনি, পরেও দেখিনি। (তিরমিযী)
হযরত আয়শা (রা.) বলেন-
إذا سر تبرق أسارير وجهه كأنه قطعة قمر
রাসূল (সা.) যখন আনন্দিত হতেন তখন তার চেহারা অধিক উজ্জল হতো, দেখলে মনে হতো যেন নক্ষত্রের এক টুকরো।
নবীজীর সৌন্দর্যের বর্ণনায় উম্মে মা’বাদ (রা.) বলেন-
এসেছিলেন মোদের ঘরে এক মোবারক মেহমান
এসেছিলেন খিমায় মোদের রূপ জগতের রাজ কুমার
লাবণ্যময় স্বর্ণ উজাল মধ্য তনুকান্তি তাঁর
সতেজ সুঠাম শোভন দেহ প্রশস্ত স্কন্ধদ্বয়
যুক্ত ভুরু গ্রীবা দীঘল চওড়া ললাট জ্যোতির্ময়
সরল সোজা উচ্চনাতি টিকালো নাক মন মোহন
গোলাপ রাঙা অধর যুগল টশটশে বেশ সুদর্শন
মুন্ড সুগোল দর্শনীয় বিনয়নত উচ্চশির
চিত্তহারি কুসুম কোমল অঙ্গে সুবাস কস্তুরির।
(কাব্যানুবাদ: কবি রূহুল আমীন খান)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন