সোমবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

কবি ও কবিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি

নোমান আহমদ
স্বয়ং রাব্বুল আলামীন যাঁর আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন; যাঁর আগমনবার্তা পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল সারা জাহান; শুধু জীন-ইনসান-আর ফিরিশতা নয় বরং পশু-পাখি থেকে বৃক্ষ-লতা পর্যন্ত যাঁর জন্মকে স্বাগত জানিয়ে ‘মারহাবা’, ‘মারহাবা’ রবে মুখরিত করেছিল পৃথিবীর আকাশ-বাতাস; যাঁর গুণকীর্তন করে রচিত হয়েছে অজস্র না’ত; অসংখ্য-অগণিত কবি-সাহিত্যিক যাঁর প্রশংসাগাঁথা রচনায় উৎসর্গ করেছেন সমগ্র জীবন; তিনি নিজে কি কাব্যপ্রেমিক ছিলেন? ছন্দোবদ্ধ গাঁথুনি আর সুচয়িত শব্দের সমন্বয়ে রচিত পংক্তিমালা কি তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করত? কবি ও কবিতার প্রতি কী ছিল তাঁর মনোভাব? উপর্যুক্ত বিষয়ে যাওয়ার পূর্বে চলুন দেখে নেই প্রাক-ইসলামী যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে কী ছিল কবি ও কবিতার অবস্থা। 
ইসলাম পূর্ব যুগে কিংবা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে কবিতাই ছিল আরবদের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। সে যুগের প্রতিটি ঘটনার সাথে জড়িত অসংখ্য কবিতা এখনো বিদ্যমান। প্রেমে ও কামে, যুদ্ধে ও শান্তিতে, হরষে ও বিষাদে, ভালবাসা ও ঘৃণায় কবিতাই ছিল আরবদের অন্যতম হাতিয়ার। তৎকালীন আরবের সাংস্কৃতিক জীবন পুরোটাই ছিল কবি ও কবিতা কেন্দ্রিক। আরবে কবি একজন সেনাপতি, বিজেতা ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কোন কবি শুধু তার ভাষার মাধ্যমে গোত্রের পর গোত্রকে ধ্বংস ও নামবিহীন করে দিত। অনুরূপভাবে কোন নাম পরিচয়হীন গোত্রকে মাত্র একজন কবিই সুখ্যাতির চূড়ায় পৌছে দিত। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটি চিত্র অধ্যাপক  R.E. Nicholson  ইবনে রাশিকের বরাতে উল্লেখ করেছেন--
“When there appeared a poet in family of the Arabs, the other tribes round about would gather together to that family and wish them joy of their luck. Feasts would be got ready, the women of the tribe would join together in bands playing upon lutes, as they were won’t to do at bridals, and the men and boys would congratulate one another; for a poet was a defense to the honour for them all, a weapon to ward off insult from their good name, and a means of perpetuating their glorious deeds and of establishing their fame forever.”

জাহেলি যুগের কবিরা ছিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সাধারন লোক সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে তাদের পরামর্শ মেনে চলত। এ কবিদের অনেকে গোত্রে-গোত্রে কলহ-বিবাদ, ঝগড়া-ফাসাদ জিইয়ে রাখত। এ ছাড়াও তাদের কবিতার প্রধান হাতিয়ার ছিল অশ্লীলতা। মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সে যুগে কবিতা ছিল ইন্দ্রিয়পরায়ন, অসংযমী, বিলাসপ্রিয় জনতার প্রেরণা ও উন্মাদনার প্রধান বাহন। এহেন পরিস্থিতিতে কবি ও কবিতার বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা--
“বিভ্রান্ত লোকরাই কবিদের অনুসরণ করে থাকে। তুমি কি দেখতে পাও না, তারা প্রতিটি উপত্যকায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়? তারা মুখে যা বলে বাস্তবে তা করে না। তবে যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং আল্লাহর যিকরে অধিকতর তৎপর রয়েছে এবং অত্যাচারিত হলে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে তাদের সম্বন্ধে ও কথা প্রযোজ্য নয়।” 
(সূরা আশ-শু‘আরা, ২২৪-২২৭)

উপরোল্লিখিত আয়াত সমূহের আলোচ্য বিষয় সমগ্র কাব্য সাহিত্য নয়; বরং যে সমস্ত কবিতা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পীড়া দিয়েছে কেবল তারই সমালোচনা করা হয়েছে। আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, কা’ব বিন মালিক এবং হাসসান বিন সাবিত (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে কাঁদতে কাঁদতে উপস্থিত হয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, কুরআনে কবিদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল হয়েছে এবং আমরা কবি।” তিনি উত্তর দিলেন, “সম্পূর্ণ আয়াত পড়, ঈমানদার, নেককারদের কথা বলা হয়নি।” তখন তাঁরা নিশ্চিত হলেন। 

পবিত্র কুরআনের অন্য একটি আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে বলা হয়েছে- “আমরা তাঁকে কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং কাজ তাঁর জন্য শোভনীয় ও নয় (সূরা ইয়াসীন)।” তিনি কবি ছিলেন না। তবুও আরবের মুশরিকরা তাঁর উপর নাযিলকৃত কুরআনের বাণী শ্রবণ করে তাঁকে কবি বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। মহান আল্লাহ এ আয়াতে শুধু সে অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেছেন। কাব্যচর্চার বৈধতা-অবৈধতার কোন ঘোষণা এখানে নেই।

কবিতা সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী: 

“যে বাণীকে বিন্যস্ত করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোন চিন্তা-চৈতন্যকে কাজে লাগানো হয়নি, সে বাণী তার নির্মাতাকে নিক্ষেপ করবে এমন এক দোযখের মধ্যে, যার পরিধি ও ব্যাপ্তি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যাবধানকেও হার মানায়।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হল। তখন তিনি বললেন, “কবিতা তো কথামালার মতই। তার উত্তম দিকটা তো উত্তমই, আর নিকৃষ্ট দিকটা নিকৃষ্টই।” (মিশকাতুল মাসাবীহ)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত-রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “ যে কেবল মানুষের হৃদয় কেড়ে নেবার জন্যই কথা ও কবিতার মালা গাঁথা শেখে; কেয়ামতের মাঠে আল্লাহ তায়ালা তার কোন বিনিময় ও গ্রহণ করবেন না এবং অথবা তার পক্ষ থেকে কোন উৎকোচ ও গ্রহণ করবেন না।” (আবু দাউদ)
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) বর্ণনা করেছেন-রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন-“নিশ্চয়ই কোন কোন কবিতা হিকমতে (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) পরিপূর্ণ।” (বূখারী)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “কোন কবির মুখনিসৃত সবচেয়ে সত্য কথা হলো কবি লাবীদ-এর কথাÑ‘জেনে রাখো আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু ধ্বংসশীল।” (বুখারী ও মুসলিম)

অশ্লীল কবিতা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মন্তব্য:

হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “গান মানুষের অন্তরে কপটতার উদ্রেক করে যেভাবে পানি শস্য উৎপাদন করে।” (বায়হাকী ফি শুয়াবিল ঈমান)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে আরজ নামক গ্রামের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছিলাম। হঠাৎ একজন কবি কবিতা (অশ্লীল) আবৃত্তি করতে করতে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তোমরা শয়তানটিকে ধর অথবা শয়তানটির গতিরোধ কর। কোন লোকের পেট কবিতা দ্বারা পূর্ণ হওয়ার চেয়ে পূঁজ দ্বারা পূর্ণ হওয়া উত্তম।” (মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন-“কবিতা দিয়ে (অশ্লীল কবিতা দিয়ে) শরীর এবং হৃদয় পরিপূর্ণ করার চেয়ে রক্ত এবং পূঁজ দিয়ে তা ভর্তি করা অনেক উত্তম।” (বুখারী ও মুসলিম)

পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, প্রাক ইসলামী যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় আরবে কবিতার নামে যা প্রচলিত ছিল তা রচনার ব্যাপারে শুধু নিরুৎসাহিতই করা হয় নি বরং এর রচয়িতাদের ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ, আরবী ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা যাদের আছে তারা এ কথা অন্তত স্বীকার করবেন সাহিত্যমানের দিক থেকে সে সময়কার কবিতাগুলো কোন অংশেই খাটো ছিল না। বরং, পবিত্র কা’বা ঘরে ঝুলন্ত সাব’উ মুয়াল্লাকার কবিতাগুলো ভাষার লালিত্য, উপমার উৎকর্ষ ও সাহিত্য সৌন্দর্যে পৃথিবীর যে কোন শ্রেষ্ঠ কাব্যের সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম। অতএব শুধু ফর্মের উৎকর্ষতা নয় বরং ইসলামী সাহিত্য কনটেক্সটের বিশুদ্ধতা ও দাবী করে। ভাষার কারুকার্য দিয়ে শ্লীল-অশ্লীলের ধার না ধেরে, উদ্ভট উপমা ও যাদুকরি ছন্দের মিশ্রণে যা তা লিখে ফেললেই তা ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা বলে গন্য হবে না। বরং এ ধরণের কবি ও কবিতা কুরআনে বর্ণিত উদ্ভান্ত চারণ কবিদের ন্যায়ই। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিকমাত বা প্রজ্ঞাপূর্ন বাণীকে এবং এর রচয়িতাকে যেমন উৎসাহিত করেছেন তেমনি অশ্লীল ও জাহেলী যুগের কাব্য ভান্ডারকে ত্রুটিপূর্ন ও বাতিলযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। 

কুরাইশদের তিন কবি--আব্দুল্লাহ বিন আজজিবারা, আবু সুফিয়ান আল হারিস এবং আমর আল আস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো কবিতার মাধ্যমে। তাদের অপতৎপরতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক সাহাবী হযরত আলী (রা.) কে এসে ধরলেন বিদ্রুপের জবাব বিদ্রুপাত্মক কবিতা দিয়ে দেওয়ার জন্য। হযরত আলী (রা.) বললেন, “হ্যাঁ, জবাব তো দেয়া যায়, জরুরী ও। তবে তার আগে চাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুমতি।” কালবিলম্ব না করেই ঐ আশিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোজা চলে গেলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এবং আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, যারা অকথ্য ভাষায় কবিতা রচনা করে আমাদের গালিগালাজ করছে তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার দরকার। ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই কাজটি করার জন্য আপনি আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) কে অনুমতি দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এই কাজের জন্য আলী তো যথোপযুক্ত নয়।” তারপর তিনি, সারওয়ারে দোজাঁহা আনসারদের ডেকে অত্যন্ত আবেগভরা ভাষায় বললেন, “অবশ্যই তোমরা আল্লাহর রাসূলকে হেফাযত করার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছ, অতন্দ্র প্রহরির ন্যায় দায়িত্ব পালন করছো। এখন সময় এসেছে সেই তাঁকে কলমের ভাষা দিয়ে হেফাযত করার। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছো যে, আজকের এই অবস্থায় তীক্ষè মসীর প্রতাপ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারো?” 
কবি সাহাবী হযরত হাস্সান বিন সাবিত (রা.) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “এ কাজের জন্য আমিই নিজেকে উৎসর্গ করছি।” এই বলে তিনি সাথে সাথে তাঁর জিহবা মেলে ধরলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে, মেলে ধরলেন জনতার সামনে। তারপর বলে উঠলেন, “আল্লাহর শপথ, আজকে থেকেই গুঞ্জরিত হবে আমার কথা, আজকে থেকেই অনুরণিত হবে আমার কবিতা সানআর নিভৃত পল্লী পর্যন্ত; বুসরা হয়ে সানআর নির্জন পল্লী পর্যন্ত মুখরিত হয়ে উঠবে আমার কবিতার পংক্তিমালায়।” সহসা প্রশ্ন করলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, “চমৎকার! কিন্তু আমি ও তো কুরাইশ বংশের, তাহলে জবাব দেবে কিভাবে (বিদ্রুপের উত্তরে বিদ্রুপ করবে কি করে)?” হাসসান বিন সাবিত (রা.) বললেন, “যেভাবে ময়দার পাকানো মন্ড থেকে চুল বাছাই করা হয় ঠিক তেমনি আপনাকে মুক্ত রাখবো ইনশাআল্লাহ।” 
সেদিন থেকেই শুরু হলো কবিতার ভাষায় জবাব। বস্তুত, কবিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের প্রচার, সুন্দরের প্রতিষ্ঠা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের প্রতিবাদে, সত্য ও ন্যায়কে বিজয়ী করার মানসেই কবিতা রচিত হওয়া উচিত। 

কবিতা রচনার নির্দেশদাতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
ক. হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, বনী কুরায়যা নামক ইহুদী গোত্রকে অবরোধ করার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে বললেন, “মুশরিকদের নিন্দা কর। নিশ্চয়ই জিবরাঈল (আ.) তোমার সাথে আছেন।” এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসসানকে মুশরিকদের কুৎসার জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন, “ হে আল্লাহ! রূহুল কুদুস (জিবরাঈল আ.) দ্বারা তাকে সাহায্য কর।” (মুসলিম)

খ. হযরত আয়শা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন, “তোমরা কবিতার মাধ্যমে কুরাইশদের নিন্দা কর। কেননা, এটা তাদের জন্য তীরের অপেক্ষা অধিক বেদনাদায়ক।” (মুসলিম)

গ. হযরত কা’ব বিন মালিক (রা.) এর প্রশ্নের জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে কবিতার যুদ্ধ শুরু কর। মু’মিনরা তো লড়াই করে জান দিয়ে ও জিহবা (ভাষা) দিয়ে। যাঁর হাতের মুঠোয় মুহাম্মদের প্রাণ, সে সত্তার কসম, তীরের তীক্ষè ফলা যেমন কলিজা ঝাঁঝরা করে দেয়, তেমনি তোমাদের কবিতাও মুশরিকদের বুক ঝাঁঝরা করে দেবে।” (মিশকাতুল মাসাবীহ)

ঘ. হযরত আম্মার বিন ইয়াসার (রা.) বলেন, এক সময় কুরাইশরা আমাদের নিন্দা চর্চায় মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি শুরু করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের ডাকলেন এবং নির্দেশ দিলেন: ‘ কুরাইশদের মত তোমরাও মুখ খোল।”

কবিতার সমঝদার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
ক. হযরত আমর বিন শারীদ (রা.) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। একবার একই বাহনে আরোহন করেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আশ শারীদ (রা.)। পথে যেতে যেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “শারীদ, তোমার কি উমাইয়া বিন আবি সালতের কোন কবিতা মুখস্ত আছে?” তিনি বললেন, “আছে।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ করলেন, “তাহলে আবৃত্তি কর, শুনি।” শারীদ (রা.) একটার পর একটা আবৃত্তি করছেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, “আরো শারীদ, আরো।” শারীদ (রা.) সেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একশটির মত কবিতা শুনিয়েছিলেন। (মুসলিম)

খ. কবি খানসা ইসলাম কবুল করলেন এবং ঐ মজলিসেই কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। খানসা (রা.) একটি শেষ করছেন তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো শুনতে চাচ্ছেন। এভাবে এক বৈঠকেই কবি খানসা (রা.)-এর নিকট হতে অনেকগুলো কবিতা শুনলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মূলত: খ্যাতনামা এই মহিলা সাহাবী  কবির কবিতা  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করতেন এবং মাঝে-মধ্যে তা শুনতে চাইতেন। 

গ. একবার বনু আউস গোত্রের বিখ্যাত কবি আনতারা বিন শাদ্দাদের একটি কবিতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনানো হলো: 
কত বিনিদ্র রজনি কেটেছে
পরিশ্রম করে করে
যোগ্যতা যেন অর্জন করি
হালাল আহার তরে।
কবিতাটি শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার পর নাই আনন্দিত হলেন এবং বললেন--“কত আরববাসীরই তো প্রশংসা শুনেছি আমি; কিন্তু তাদের কারো সাথেই দেখা করার আগ্রহ বোধ করিনি। কিন্তু সত্যিই বলছি, এই কবিতার কবিকে এক নজর দেখার জন্য আমার মধ্যে এখন একটি স্বতস্ফ’র্ততা কাজ করছে।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু কাব্য প্রেমিকই ছিলেন না বরং কবিতার এক যথার্থ সমঝদার ছিলেন। কবিতার ভাব ও ভাষা তাকে যে মুগ্ধ করত তা ই নয় বরং অনেক কবির কবিতাই তিনি সংশোধন করে দিয়েছেন, দিয়েছেন অনেক কবিতার পূর্ণতাও। 

কবিতা সম্পাদনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
ক. কবি কা’ব বিন যুহায়র-এর প্রাণদন্ড ঘোষণা করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রাণ ভয়ে ভীত কবি চুপিচুপি এসেছেন ক্ষমা চাইতে। ক্ষমা চেয়ে তওবা করলেন এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক হাতে হাত রেখে ইসলাম কবুল করলেন। তারপর রাসূলেপ প্রশস্তি গেয়ে সুদীর্ঘ “কাসীদা বানাত সু’আদ” আবৃত্তি করা শুরু করলেন। পড়তে পড়তে যখন উচ্চারন করলেন:
রাসূল আমার পূর্ণ আলোর বলয়-
আঁধারের পথ উজ্জ্বল হলো তাতে
খাপ খোলা এক মুক্ত সে তরবারি
ভারতের তা- চকচকে ধার যাতে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে থামিয়ে দিয়ে সংশোধন করে দিলেন এই বলে যে, “ভারতের তরবারি নয় বরং আল্লাহর তরবারি।” কবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথামত তা সংশোধন করে নিলেন। 

খ. পারস্যের বিখ্যাত কবি হযরত শেখ সাদী (র.) রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর শানে কাব্য রচনায় লিপ্ত হলেন। লিখে ফেললেন কালজয়ী সেই বিখ্যাত নাতের প্রথম তিন পংক্তি:
“বালাগাল উলা বিকামালিহী
কাশাফাদ্দোজা বিজামালিহী
হাসুনাত জামিউ খিসালিহী”
এরপর থমকে গেল কবির কবিতা। একই ছন্দের, সমদৈর্ঘের ও সমমর্যাদার আর একটি পংক্তি খুঁজে চলেছেন কবি নিরন্তর। হঠাৎ একদিন স্বপ্নে দীদার নসীব হলো প্রিয়তম রাসূলের। চিন্তিত কবিকে তিনি বললেন-- হে সাদী! এত বিমর্ষ কেন? পরের লাইন লিখ:‘সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।”

 উপরোক্ত ঘটনাদ্বয় শুধু কবিতার নয় বরং বিশ্বাসী কবিদের প্রতিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে ভালবাসা ছিল তার প্রমাণ। 

কাব্য রচনার পুরস্কার দিলেন স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: 
ক. হুনায়নের যুদ্ধ শেষে গনীমতের মাল বিতরণ করছেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। একপর্যায়ে কবি সাহাবী হযরত আব্বাস বিন মিরদাস (রা.) কে দিলেন চারটি উট, হৃষ্ট পুষ্ট চারটি উট। কিন্তু মন ভরলো না তাঁর। কবিতার ছন্দে অনুযোগ জানালেন:
“ঘাড় ভাঙতে তো পারেনি কো মিরদাসের
কোনদিনও কোন বধ্যভূমি ও কেল্লা, 
পেছনে ও ছিলাম না কখনো কোন দিন,
তবুও আজকে কম পেয়ে কেন ছোট হব?
হায় আল্লাহ! হায় আল্লাহ!”
আব্বাস বিন মিরদাসের (রা.) কবিতার মর্মার্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝলেন, তারপর হাঁক দিলেন--“এই কবির মুখ বন্ধ করার মত কেউ কি নেই এখানে?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ডাক শুনে হযরত আবু বকর (রা.) এগিয়ে এলেন এবং কবিকে সেখানে নিয়ে গেলেন যেখানে জড়ো করা হয়েছে মালে গনীমত। অতপর বাছাই করে একশত উট দিলেন তাকে। অনুযোগের পরিবর্তে খুশিতে ডগমগ করে উঠলো কবির চেহারা। (ইয়াহইয়া উলুম আদদীন)
খ. কবিতা আবৃত্তির জন্য “শায়িরুর রাসূল” বা রাসূলের কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাসজিদে নববীতে পৃথক একটি মিম্বর তৈরী করে দিয়েছিলেন। একদা নিজ আসনে বসে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে কথার লড়াই চালাচ্ছিলেন কবি। তাঁর আবৃত্তি শুনে ভীষণ খুশি হলেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দেহ মুবারক থেকে চাদর খুলে উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন হাসসানকে। 

গ. হযরত কা’ব বিন যুহায়র (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে এসে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। অতপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে রচিত “কাসীদা বানাত সুআদ” নামে পরিচিত সুদীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। কবিতা শুনে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত বেশী খুশি হলেন, কা’ব বিন যুহায়র-এর মৃত্যুদন্ড তো রহিত হলোই সাথে সাথে তিনি উপহার হিসেবে পেলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র শরীরের ইয়ামনী চাদর খানা। 

এমনিভাবে রাসূলে পাকের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শানে কবিতা রচনা করে কঠিন পক্ষাঘাত থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন ইমাম শরফুদ্দীন বুসিরী (র.) এবং উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাদর মুবারক। তাইতো তার অমর কবিতাটি “কাসীদায়ে বুরদাহ” নামে সমধিক পরিচিত। ‘বুরদাহ’ শব্দের অর্থই হচ্ছে চাদর। 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শরীয়ত প্রবর্তক। পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটেছিল “সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।” মানুষের সুকুমার বৃত্তি এবং মানবিক মূল্যবোধ তৈরীতে কবিতার ভূমিকা অপরিসীম। এ জন্যই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন. “নিশ্চয়ই কোন কোন কথায় রয়েছে যাদু (আকর্ষণ ক্ষমতা)।”
কবিতার যাদুকরি প্রভাবের কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিতা শুনতেন, কবিতা পছন্দ করতেন, কবিদের ভালবাসতেন। তিনি শুধু কবিতা রচনার নির্দেশই দেননি বরং ভালো কবিতাকে করেছেন পুরস্কৃতও । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিতা বলতে অন্তসারশূন্য, ছন্দোবদ্ধ, উপমা বহুল ভাষাকে বুঝান নি। বরং ভাব ও ভাষার সমন্বয়ে অর্থপূর্ণ রচনাকেই কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অপসংস্কৃতির সয়লাবের এই যুগে এ ধরনের কবিতাই পারে সদাচঞ্চল তারুণ্যকে সঠিক পথ দেখাতে। সুতরাং, আমাদের যারা কলমকে দ্বীন প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী, যাদের লেখনীর উদ্দেশ্য সস্তা বাহবা কুড়ানো নয় বরং আহরিত জ্ঞানকে সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া, দেশ-জাতি-উম্মাহর কল্যাণে যারা নিবেদিত করতে চাই নিজের মসী শক্তিকে তাদের সকলকে এ ব্যাপারে আরো যতœবান হওয়ার আহবান জানাচ্ছি। সস্তা ভাব, চটুল ভাষা আর মিথ্যা উপমায় যেন ভারাক্রান্ত না হয় আমাদের কবিতাগুলো। আলী ইবনে আবু তালিব, হাসসান বিন সাবিত, কা’ব বিন মালিক, কা’ব বিন যুহায়র, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা.), ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুসিরী, শেখ সাদী, রুমী, জামী, আল্লামা ইকবাল, আলতাফ হালী, নজরুল, ফররুখের মত আমাদের কবিতা যেন হয় অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের হাতিয়ার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে  ন্যায়ের অজেয় দুর্গ। উম্মাহর এই দুর্দিনে, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে কবিতাই হোক জাগরণের হাতিয়ার। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন