সোমবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

আল্লামা ফুলতলী (র.) : অতুলনীয় গুণসম্পন্ন মহান বুযুর্গ

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

ফুলতলী হুযূরের সাথে আমার পরিচয় বহুদিন আগে থেকে। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁকে আমি কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করি তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমি ছাত্র বয়স থেকেই তাঁকে নানাভাবে দেখেছি। আমার মনে পড়ে পঞ্চাশ দশকের দিকে একদিন বাংলাদেশের বড় বড় আলেমদের এক বৈঠকে মাগরিবের নামাযের সময় হলে হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) ইমামতির জন্য ফুলতলী ছাহেবকে বলেন। তখন ফুলতলী ছাহেব বলেন, ‘আমরা একজন হাফিয ছাহেবের পেছনে নামায পড়ব’। একথা বলে তিনি আতহার আলী (র.)-এর দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন। আতহার আলী (র.) বলে উঠলেন, ‘আপনি তো হাফিযের দাদা’। আতহার আলী (র.) হযরত ফুলতলী (র.)-কে কী দৃষ্টিতে দেখতেন তা তার মন্তব্য থেকেই অনুমান করা যায়। সেদিন সকল আলেমের নামাযের ইমামতি ফুলতলী (র.)-ই করেছিলেন।
আমি তাঁর মাঝে এমন কিছু গুণ প্রত্যক্ষ করেছি যেগুলো খুবই বিরল। তিনি একাধারে সাহসী, কষ্ট সহিষ্ণু, বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ও দীনের তরে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দীনের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেয়ার জন্য প্রতি প্রস্তুত থাকতেন।
আমি হযরত ফুলতলী (র.)-এর মাঝে শহীদে বালাকোট হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ (র.)-এর প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি। তাঁর মাঝে সায়্যিদ (র.)-এর চেতনা যথাযথ ভাবে পরিস্ফুুট ছিল। সায়্যিদ (র.)-এর চেতনাকে তিনিই আমাদের দেশে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা হুযূরকে আল-কুরআন আল-কারীমের খাদিম হিসেবে কবূল করেছিলেন। তিনি আল-কুরআন বিশুদ্ধভাবে পাঠের যে অনুপম ব্যবস্থা করে ও রেখে গেছেন তা এককথায় অসাধারণ। আমার মনে হয়েছে আল্লাহ কুরআনের খিদমতের জন্য তাঁকে বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন সর্বোতভাবে মানুষের কল্যাণকামী। অন্যের উপকার করা, অন্যের দুঃখে কষ্ট পাওয়া এ গুণগুলো তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্টের অন্যতম দিক।
তিনি অগণিত মাদরাসা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। মাদরাসা শিক্ষার বিস্তার ও এর স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি জীবন সায়াহ্নে মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় লংমার্চ নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে এ লংমার্চ পরবর্তী সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছে। আমি তাঁর কাছেই ছিলাম।
ছোট খাটো কিছু মাসআলায় ভিন্নমতের কারণে কেউ কেউ তাঁর বিষয়ে মন্তব্য করতে চাইলে আমি সবসময় সোচ্চারকন্ঠে এর প্রতিবাদ করেছি। এমনকি আমি জমিয়তের এক সভায় প্রস্তাব করেছিলামÑ‘আসুন আমরা ফুলতলী হুযূরকে আমাদের পৃষ্ঠপোষক মনোনীত করি।’ তখন অনেকে বলেছিলেনÑ‘তিনি এতে রাজি হবেন নাকি?’ বলেছিলাম- ‘আমি গিয়ে যদি আবদার করি, হুযূর আমার কথা ফেলবেন না।’ এটা আমি বলেছি আমার মনের দাবি থেকে। কারণ আমি জানতাম তিনি আমাকে কত ভালোবাসেন।
আল্লাহর পথের এ মর্দে মুজাহিদ আমাদের মাঝে নেই। আমরা যদি তাঁর রেখে যাওয়া অমূল্য খিদমতগুলো ধরে রাখতে পারি তাহলে এ মিল্লাতের জন্য তা হবে কল্যাণকর।

[লেখক : সম্পাদক-মাসিক মদীনা, আলিমে দীন ও ইসলামী সাহিত্যের দিকপাল]
(সূত্র : হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক)

কবি ও কবিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি

নোমান আহমদ
স্বয়ং রাব্বুল আলামীন যাঁর আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন; যাঁর আগমনবার্তা পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল সারা জাহান; শুধু জীন-ইনসান-আর ফিরিশতা নয় বরং পশু-পাখি থেকে বৃক্ষ-লতা পর্যন্ত যাঁর জন্মকে স্বাগত জানিয়ে ‘মারহাবা’, ‘মারহাবা’ রবে মুখরিত করেছিল পৃথিবীর আকাশ-বাতাস; যাঁর গুণকীর্তন করে রচিত হয়েছে অজস্র না’ত; অসংখ্য-অগণিত কবি-সাহিত্যিক যাঁর প্রশংসাগাঁথা রচনায় উৎসর্গ করেছেন সমগ্র জীবন; তিনি নিজে কি কাব্যপ্রেমিক ছিলেন? ছন্দোবদ্ধ গাঁথুনি আর সুচয়িত শব্দের সমন্বয়ে রচিত পংক্তিমালা কি তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করত? কবি ও কবিতার প্রতি কী ছিল তাঁর মনোভাব? উপর্যুক্ত বিষয়ে যাওয়ার পূর্বে চলুন দেখে নেই প্রাক-ইসলামী যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে কী ছিল কবি ও কবিতার অবস্থা। 
ইসলাম পূর্ব যুগে কিংবা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে কবিতাই ছিল আরবদের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। সে যুগের প্রতিটি ঘটনার সাথে জড়িত অসংখ্য কবিতা এখনো বিদ্যমান। প্রেমে ও কামে, যুদ্ধে ও শান্তিতে, হরষে ও বিষাদে, ভালবাসা ও ঘৃণায় কবিতাই ছিল আরবদের অন্যতম হাতিয়ার। তৎকালীন আরবের সাংস্কৃতিক জীবন পুরোটাই ছিল কবি ও কবিতা কেন্দ্রিক। আরবে কবি একজন সেনাপতি, বিজেতা ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কোন কবি শুধু তার ভাষার মাধ্যমে গোত্রের পর গোত্রকে ধ্বংস ও নামবিহীন করে দিত। অনুরূপভাবে কোন নাম পরিচয়হীন গোত্রকে মাত্র একজন কবিই সুখ্যাতির চূড়ায় পৌছে দিত। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটি চিত্র অধ্যাপক  R.E. Nicholson  ইবনে রাশিকের বরাতে উল্লেখ করেছেন--
“When there appeared a poet in family of the Arabs, the other tribes round about would gather together to that family and wish them joy of their luck. Feasts would be got ready, the women of the tribe would join together in bands playing upon lutes, as they were won’t to do at bridals, and the men and boys would congratulate one another; for a poet was a defense to the honour for them all, a weapon to ward off insult from their good name, and a means of perpetuating their glorious deeds and of establishing their fame forever.”

জাহেলি যুগের কবিরা ছিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সাধারন লোক সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে তাদের পরামর্শ মেনে চলত। এ কবিদের অনেকে গোত্রে-গোত্রে কলহ-বিবাদ, ঝগড়া-ফাসাদ জিইয়ে রাখত। এ ছাড়াও তাদের কবিতার প্রধান হাতিয়ার ছিল অশ্লীলতা। মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সে যুগে কবিতা ছিল ইন্দ্রিয়পরায়ন, অসংযমী, বিলাসপ্রিয় জনতার প্রেরণা ও উন্মাদনার প্রধান বাহন। এহেন পরিস্থিতিতে কবি ও কবিতার বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা--
“বিভ্রান্ত লোকরাই কবিদের অনুসরণ করে থাকে। তুমি কি দেখতে পাও না, তারা প্রতিটি উপত্যকায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়? তারা মুখে যা বলে বাস্তবে তা করে না। তবে যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং আল্লাহর যিকরে অধিকতর তৎপর রয়েছে এবং অত্যাচারিত হলে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে তাদের সম্বন্ধে ও কথা প্রযোজ্য নয়।” 
(সূরা আশ-শু‘আরা, ২২৪-২২৭)

উপরোল্লিখিত আয়াত সমূহের আলোচ্য বিষয় সমগ্র কাব্য সাহিত্য নয়; বরং যে সমস্ত কবিতা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পীড়া দিয়েছে কেবল তারই সমালোচনা করা হয়েছে। আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, কা’ব বিন মালিক এবং হাসসান বিন সাবিত (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে কাঁদতে কাঁদতে উপস্থিত হয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, কুরআনে কবিদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল হয়েছে এবং আমরা কবি।” তিনি উত্তর দিলেন, “সম্পূর্ণ আয়াত পড়, ঈমানদার, নেককারদের কথা বলা হয়নি।” তখন তাঁরা নিশ্চিত হলেন। 

পবিত্র কুরআনের অন্য একটি আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে বলা হয়েছে- “আমরা তাঁকে কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং কাজ তাঁর জন্য শোভনীয় ও নয় (সূরা ইয়াসীন)।” তিনি কবি ছিলেন না। তবুও আরবের মুশরিকরা তাঁর উপর নাযিলকৃত কুরআনের বাণী শ্রবণ করে তাঁকে কবি বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। মহান আল্লাহ এ আয়াতে শুধু সে অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেছেন। কাব্যচর্চার বৈধতা-অবৈধতার কোন ঘোষণা এখানে নেই।

কবিতা সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী: 

“যে বাণীকে বিন্যস্ত করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোন চিন্তা-চৈতন্যকে কাজে লাগানো হয়নি, সে বাণী তার নির্মাতাকে নিক্ষেপ করবে এমন এক দোযখের মধ্যে, যার পরিধি ও ব্যাপ্তি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যাবধানকেও হার মানায়।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হল। তখন তিনি বললেন, “কবিতা তো কথামালার মতই। তার উত্তম দিকটা তো উত্তমই, আর নিকৃষ্ট দিকটা নিকৃষ্টই।” (মিশকাতুল মাসাবীহ)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত-রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “ যে কেবল মানুষের হৃদয় কেড়ে নেবার জন্যই কথা ও কবিতার মালা গাঁথা শেখে; কেয়ামতের মাঠে আল্লাহ তায়ালা তার কোন বিনিময় ও গ্রহণ করবেন না এবং অথবা তার পক্ষ থেকে কোন উৎকোচ ও গ্রহণ করবেন না।” (আবু দাউদ)
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) বর্ণনা করেছেন-রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন-“নিশ্চয়ই কোন কোন কবিতা হিকমতে (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) পরিপূর্ণ।” (বূখারী)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “কোন কবির মুখনিসৃত সবচেয়ে সত্য কথা হলো কবি লাবীদ-এর কথাÑ‘জেনে রাখো আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু ধ্বংসশীল।” (বুখারী ও মুসলিম)

অশ্লীল কবিতা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মন্তব্য:

হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “গান মানুষের অন্তরে কপটতার উদ্রেক করে যেভাবে পানি শস্য উৎপাদন করে।” (বায়হাকী ফি শুয়াবিল ঈমান)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে আরজ নামক গ্রামের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছিলাম। হঠাৎ একজন কবি কবিতা (অশ্লীল) আবৃত্তি করতে করতে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তোমরা শয়তানটিকে ধর অথবা শয়তানটির গতিরোধ কর। কোন লোকের পেট কবিতা দ্বারা পূর্ণ হওয়ার চেয়ে পূঁজ দ্বারা পূর্ণ হওয়া উত্তম।” (মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন-“কবিতা দিয়ে (অশ্লীল কবিতা দিয়ে) শরীর এবং হৃদয় পরিপূর্ণ করার চেয়ে রক্ত এবং পূঁজ দিয়ে তা ভর্তি করা অনেক উত্তম।” (বুখারী ও মুসলিম)

পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, প্রাক ইসলামী যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় আরবে কবিতার নামে যা প্রচলিত ছিল তা রচনার ব্যাপারে শুধু নিরুৎসাহিতই করা হয় নি বরং এর রচয়িতাদের ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ, আরবী ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা যাদের আছে তারা এ কথা অন্তত স্বীকার করবেন সাহিত্যমানের দিক থেকে সে সময়কার কবিতাগুলো কোন অংশেই খাটো ছিল না। বরং, পবিত্র কা’বা ঘরে ঝুলন্ত সাব’উ মুয়াল্লাকার কবিতাগুলো ভাষার লালিত্য, উপমার উৎকর্ষ ও সাহিত্য সৌন্দর্যে পৃথিবীর যে কোন শ্রেষ্ঠ কাব্যের সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম। অতএব শুধু ফর্মের উৎকর্ষতা নয় বরং ইসলামী সাহিত্য কনটেক্সটের বিশুদ্ধতা ও দাবী করে। ভাষার কারুকার্য দিয়ে শ্লীল-অশ্লীলের ধার না ধেরে, উদ্ভট উপমা ও যাদুকরি ছন্দের মিশ্রণে যা তা লিখে ফেললেই তা ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা বলে গন্য হবে না। বরং এ ধরণের কবি ও কবিতা কুরআনে বর্ণিত উদ্ভান্ত চারণ কবিদের ন্যায়ই। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিকমাত বা প্রজ্ঞাপূর্ন বাণীকে এবং এর রচয়িতাকে যেমন উৎসাহিত করেছেন তেমনি অশ্লীল ও জাহেলী যুগের কাব্য ভান্ডারকে ত্রুটিপূর্ন ও বাতিলযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। 

কুরাইশদের তিন কবি--আব্দুল্লাহ বিন আজজিবারা, আবু সুফিয়ান আল হারিস এবং আমর আল আস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো কবিতার মাধ্যমে। তাদের অপতৎপরতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক সাহাবী হযরত আলী (রা.) কে এসে ধরলেন বিদ্রুপের জবাব বিদ্রুপাত্মক কবিতা দিয়ে দেওয়ার জন্য। হযরত আলী (রা.) বললেন, “হ্যাঁ, জবাব তো দেয়া যায়, জরুরী ও। তবে তার আগে চাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুমতি।” কালবিলম্ব না করেই ঐ আশিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোজা চলে গেলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এবং আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, যারা অকথ্য ভাষায় কবিতা রচনা করে আমাদের গালিগালাজ করছে তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার দরকার। ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই কাজটি করার জন্য আপনি আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) কে অনুমতি দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এই কাজের জন্য আলী তো যথোপযুক্ত নয়।” তারপর তিনি, সারওয়ারে দোজাঁহা আনসারদের ডেকে অত্যন্ত আবেগভরা ভাষায় বললেন, “অবশ্যই তোমরা আল্লাহর রাসূলকে হেফাযত করার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছ, অতন্দ্র প্রহরির ন্যায় দায়িত্ব পালন করছো। এখন সময় এসেছে সেই তাঁকে কলমের ভাষা দিয়ে হেফাযত করার। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছো যে, আজকের এই অবস্থায় তীক্ষè মসীর প্রতাপ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারো?” 
কবি সাহাবী হযরত হাস্সান বিন সাবিত (রা.) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “এ কাজের জন্য আমিই নিজেকে উৎসর্গ করছি।” এই বলে তিনি সাথে সাথে তাঁর জিহবা মেলে ধরলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে, মেলে ধরলেন জনতার সামনে। তারপর বলে উঠলেন, “আল্লাহর শপথ, আজকে থেকেই গুঞ্জরিত হবে আমার কথা, আজকে থেকেই অনুরণিত হবে আমার কবিতা সানআর নিভৃত পল্লী পর্যন্ত; বুসরা হয়ে সানআর নির্জন পল্লী পর্যন্ত মুখরিত হয়ে উঠবে আমার কবিতার পংক্তিমালায়।” সহসা প্রশ্ন করলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, “চমৎকার! কিন্তু আমি ও তো কুরাইশ বংশের, তাহলে জবাব দেবে কিভাবে (বিদ্রুপের উত্তরে বিদ্রুপ করবে কি করে)?” হাসসান বিন সাবিত (রা.) বললেন, “যেভাবে ময়দার পাকানো মন্ড থেকে চুল বাছাই করা হয় ঠিক তেমনি আপনাকে মুক্ত রাখবো ইনশাআল্লাহ।” 
সেদিন থেকেই শুরু হলো কবিতার ভাষায় জবাব। বস্তুত, কবিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের প্রচার, সুন্দরের প্রতিষ্ঠা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের প্রতিবাদে, সত্য ও ন্যায়কে বিজয়ী করার মানসেই কবিতা রচিত হওয়া উচিত। 

কবিতা রচনার নির্দেশদাতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
ক. হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, বনী কুরায়যা নামক ইহুদী গোত্রকে অবরোধ করার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে বললেন, “মুশরিকদের নিন্দা কর। নিশ্চয়ই জিবরাঈল (আ.) তোমার সাথে আছেন।” এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসসানকে মুশরিকদের কুৎসার জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন, “ হে আল্লাহ! রূহুল কুদুস (জিবরাঈল আ.) দ্বারা তাকে সাহায্য কর।” (মুসলিম)

খ. হযরত আয়শা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন, “তোমরা কবিতার মাধ্যমে কুরাইশদের নিন্দা কর। কেননা, এটা তাদের জন্য তীরের অপেক্ষা অধিক বেদনাদায়ক।” (মুসলিম)

গ. হযরত কা’ব বিন মালিক (রা.) এর প্রশ্নের জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে কবিতার যুদ্ধ শুরু কর। মু’মিনরা তো লড়াই করে জান দিয়ে ও জিহবা (ভাষা) দিয়ে। যাঁর হাতের মুঠোয় মুহাম্মদের প্রাণ, সে সত্তার কসম, তীরের তীক্ষè ফলা যেমন কলিজা ঝাঁঝরা করে দেয়, তেমনি তোমাদের কবিতাও মুশরিকদের বুক ঝাঁঝরা করে দেবে।” (মিশকাতুল মাসাবীহ)

ঘ. হযরত আম্মার বিন ইয়াসার (রা.) বলেন, এক সময় কুরাইশরা আমাদের নিন্দা চর্চায় মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি শুরু করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের ডাকলেন এবং নির্দেশ দিলেন: ‘ কুরাইশদের মত তোমরাও মুখ খোল।”

কবিতার সমঝদার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
ক. হযরত আমর বিন শারীদ (রা.) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। একবার একই বাহনে আরোহন করেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আশ শারীদ (রা.)। পথে যেতে যেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “শারীদ, তোমার কি উমাইয়া বিন আবি সালতের কোন কবিতা মুখস্ত আছে?” তিনি বললেন, “আছে।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ করলেন, “তাহলে আবৃত্তি কর, শুনি।” শারীদ (রা.) একটার পর একটা আবৃত্তি করছেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, “আরো শারীদ, আরো।” শারীদ (রা.) সেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একশটির মত কবিতা শুনিয়েছিলেন। (মুসলিম)

খ. কবি খানসা ইসলাম কবুল করলেন এবং ঐ মজলিসেই কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। খানসা (রা.) একটি শেষ করছেন তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো শুনতে চাচ্ছেন। এভাবে এক বৈঠকেই কবি খানসা (রা.)-এর নিকট হতে অনেকগুলো কবিতা শুনলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মূলত: খ্যাতনামা এই মহিলা সাহাবী  কবির কবিতা  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করতেন এবং মাঝে-মধ্যে তা শুনতে চাইতেন। 

গ. একবার বনু আউস গোত্রের বিখ্যাত কবি আনতারা বিন শাদ্দাদের একটি কবিতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনানো হলো: 
কত বিনিদ্র রজনি কেটেছে
পরিশ্রম করে করে
যোগ্যতা যেন অর্জন করি
হালাল আহার তরে।
কবিতাটি শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার পর নাই আনন্দিত হলেন এবং বললেন--“কত আরববাসীরই তো প্রশংসা শুনেছি আমি; কিন্তু তাদের কারো সাথেই দেখা করার আগ্রহ বোধ করিনি। কিন্তু সত্যিই বলছি, এই কবিতার কবিকে এক নজর দেখার জন্য আমার মধ্যে এখন একটি স্বতস্ফ’র্ততা কাজ করছে।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু কাব্য প্রেমিকই ছিলেন না বরং কবিতার এক যথার্থ সমঝদার ছিলেন। কবিতার ভাব ও ভাষা তাকে যে মুগ্ধ করত তা ই নয় বরং অনেক কবির কবিতাই তিনি সংশোধন করে দিয়েছেন, দিয়েছেন অনেক কবিতার পূর্ণতাও। 

কবিতা সম্পাদনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
ক. কবি কা’ব বিন যুহায়র-এর প্রাণদন্ড ঘোষণা করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রাণ ভয়ে ভীত কবি চুপিচুপি এসেছেন ক্ষমা চাইতে। ক্ষমা চেয়ে তওবা করলেন এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক হাতে হাত রেখে ইসলাম কবুল করলেন। তারপর রাসূলেপ প্রশস্তি গেয়ে সুদীর্ঘ “কাসীদা বানাত সু’আদ” আবৃত্তি করা শুরু করলেন। পড়তে পড়তে যখন উচ্চারন করলেন:
রাসূল আমার পূর্ণ আলোর বলয়-
আঁধারের পথ উজ্জ্বল হলো তাতে
খাপ খোলা এক মুক্ত সে তরবারি
ভারতের তা- চকচকে ধার যাতে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে থামিয়ে দিয়ে সংশোধন করে দিলেন এই বলে যে, “ভারতের তরবারি নয় বরং আল্লাহর তরবারি।” কবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথামত তা সংশোধন করে নিলেন। 

খ. পারস্যের বিখ্যাত কবি হযরত শেখ সাদী (র.) রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর শানে কাব্য রচনায় লিপ্ত হলেন। লিখে ফেললেন কালজয়ী সেই বিখ্যাত নাতের প্রথম তিন পংক্তি:
“বালাগাল উলা বিকামালিহী
কাশাফাদ্দোজা বিজামালিহী
হাসুনাত জামিউ খিসালিহী”
এরপর থমকে গেল কবির কবিতা। একই ছন্দের, সমদৈর্ঘের ও সমমর্যাদার আর একটি পংক্তি খুঁজে চলেছেন কবি নিরন্তর। হঠাৎ একদিন স্বপ্নে দীদার নসীব হলো প্রিয়তম রাসূলের। চিন্তিত কবিকে তিনি বললেন-- হে সাদী! এত বিমর্ষ কেন? পরের লাইন লিখ:‘সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।”

 উপরোক্ত ঘটনাদ্বয় শুধু কবিতার নয় বরং বিশ্বাসী কবিদের প্রতিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে ভালবাসা ছিল তার প্রমাণ। 

কাব্য রচনার পুরস্কার দিলেন স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: 
ক. হুনায়নের যুদ্ধ শেষে গনীমতের মাল বিতরণ করছেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। একপর্যায়ে কবি সাহাবী হযরত আব্বাস বিন মিরদাস (রা.) কে দিলেন চারটি উট, হৃষ্ট পুষ্ট চারটি উট। কিন্তু মন ভরলো না তাঁর। কবিতার ছন্দে অনুযোগ জানালেন:
“ঘাড় ভাঙতে তো পারেনি কো মিরদাসের
কোনদিনও কোন বধ্যভূমি ও কেল্লা, 
পেছনে ও ছিলাম না কখনো কোন দিন,
তবুও আজকে কম পেয়ে কেন ছোট হব?
হায় আল্লাহ! হায় আল্লাহ!”
আব্বাস বিন মিরদাসের (রা.) কবিতার মর্মার্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝলেন, তারপর হাঁক দিলেন--“এই কবির মুখ বন্ধ করার মত কেউ কি নেই এখানে?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ডাক শুনে হযরত আবু বকর (রা.) এগিয়ে এলেন এবং কবিকে সেখানে নিয়ে গেলেন যেখানে জড়ো করা হয়েছে মালে গনীমত। অতপর বাছাই করে একশত উট দিলেন তাকে। অনুযোগের পরিবর্তে খুশিতে ডগমগ করে উঠলো কবির চেহারা। (ইয়াহইয়া উলুম আদদীন)
খ. কবিতা আবৃত্তির জন্য “শায়িরুর রাসূল” বা রাসূলের কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাসজিদে নববীতে পৃথক একটি মিম্বর তৈরী করে দিয়েছিলেন। একদা নিজ আসনে বসে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে কথার লড়াই চালাচ্ছিলেন কবি। তাঁর আবৃত্তি শুনে ভীষণ খুশি হলেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দেহ মুবারক থেকে চাদর খুলে উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন হাসসানকে। 

গ. হযরত কা’ব বিন যুহায়র (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে এসে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। অতপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে রচিত “কাসীদা বানাত সুআদ” নামে পরিচিত সুদীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। কবিতা শুনে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত বেশী খুশি হলেন, কা’ব বিন যুহায়র-এর মৃত্যুদন্ড তো রহিত হলোই সাথে সাথে তিনি উপহার হিসেবে পেলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র শরীরের ইয়ামনী চাদর খানা। 

এমনিভাবে রাসূলে পাকের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শানে কবিতা রচনা করে কঠিন পক্ষাঘাত থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন ইমাম শরফুদ্দীন বুসিরী (র.) এবং উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাদর মুবারক। তাইতো তার অমর কবিতাটি “কাসীদায়ে বুরদাহ” নামে সমধিক পরিচিত। ‘বুরদাহ’ শব্দের অর্থই হচ্ছে চাদর। 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শরীয়ত প্রবর্তক। পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটেছিল “সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।” মানুষের সুকুমার বৃত্তি এবং মানবিক মূল্যবোধ তৈরীতে কবিতার ভূমিকা অপরিসীম। এ জন্যই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন. “নিশ্চয়ই কোন কোন কথায় রয়েছে যাদু (আকর্ষণ ক্ষমতা)।”
কবিতার যাদুকরি প্রভাবের কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিতা শুনতেন, কবিতা পছন্দ করতেন, কবিদের ভালবাসতেন। তিনি শুধু কবিতা রচনার নির্দেশই দেননি বরং ভালো কবিতাকে করেছেন পুরস্কৃতও । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিতা বলতে অন্তসারশূন্য, ছন্দোবদ্ধ, উপমা বহুল ভাষাকে বুঝান নি। বরং ভাব ও ভাষার সমন্বয়ে অর্থপূর্ণ রচনাকেই কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অপসংস্কৃতির সয়লাবের এই যুগে এ ধরনের কবিতাই পারে সদাচঞ্চল তারুণ্যকে সঠিক পথ দেখাতে। সুতরাং, আমাদের যারা কলমকে দ্বীন প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী, যাদের লেখনীর উদ্দেশ্য সস্তা বাহবা কুড়ানো নয় বরং আহরিত জ্ঞানকে সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া, দেশ-জাতি-উম্মাহর কল্যাণে যারা নিবেদিত করতে চাই নিজের মসী শক্তিকে তাদের সকলকে এ ব্যাপারে আরো যতœবান হওয়ার আহবান জানাচ্ছি। সস্তা ভাব, চটুল ভাষা আর মিথ্যা উপমায় যেন ভারাক্রান্ত না হয় আমাদের কবিতাগুলো। আলী ইবনে আবু তালিব, হাসসান বিন সাবিত, কা’ব বিন মালিক, কা’ব বিন যুহায়র, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা.), ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুসিরী, শেখ সাদী, রুমী, জামী, আল্লামা ইকবাল, আলতাফ হালী, নজরুল, ফররুখের মত আমাদের কবিতা যেন হয় অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের হাতিয়ার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে  ন্যায়ের অজেয় দুর্গ। উম্মাহর এই দুর্দিনে, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে কবিতাই হোক জাগরণের হাতিয়ার। 

শুক্রবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

পুস্তক আলোচনা : ‘এশকে রাসূল’ বিন্দুর মাঝে সিন্ধু

 এশকে রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
মূল: ড. তাহের আল কাদেরী
ভাষান্তর: মাওলানা মীর জাভেদ ইকবাল
সম্পাদনা : আবূ আহমেদ জামেউল আখতার চৌধুরী
প্রকাশক: মোহাম্মদ আবূ তৈয়ব চৌধুরী
সন্জরী পাবলিকেশন

 মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
এশকে রাসূল মুমিন জীবনের প্রতি মুহূর্তে অতি কাক্সিক্ষত একটি বিষয়। মুমিন মাত্রই রাসূলে পাক (সা.)-এর এশকে বিভোর হয়ে তাঁরই ভালবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। এশকে রাসূল তথা হুব্বে রাসূল মুসলমানের ঈমানের অন্যতম মূল বিষয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সর্বোচ্চ ভালবাসা না থাকলে ঈমান পূর্ণ হয় না। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলে মাকবূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ ইমানদার হবে না যে পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হব।’ একজন মুসলমান যাতে নিজেকে রাসূলের প্রেম সাগরে আপাদমস্তক ডুবিয়ে দিতে পারে সেজন্য রাসূলপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, এর প্রকৃতি কেমন হবে, রাসূলে পাক (সা.)-এর পরিচয় কি এবং তাঁর প্রিয় সাহাবাদের তাঁর প্রতি ভালবাসা কেমন ছিল এমন বিষয় নিয়ে যুগে যুগে আশিকে রাসূলগণ নিজেদের প্রেমময় কাব্য-পংক্তিমালার পসরা সাজিয়েছেন তেমনি অনেকে লিখে গেছেন কালোত্তীর্ণ রচনা। এ ধারায়  নিজেকে শক্তভাবে যুক্ত করে নিয়েছেন বর্তমান সময়ের সেরা লেখক ও ইসলামী গবেষক, অসাধারণ বাগ্মী, সময়ের সেরা সংগঠক ও ইসলামী  চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. তাহের আল কাদেরী। উর্দূ, ইংরেজী ও আরবী ভাষায় এ পর্যন্ত তাঁর রচিত  তিনশ’র বেশী  গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সকল রচনাই ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা নির্ভর। তাঁর রচনার অন্যতম হলো ‘এশ্্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। এ রচনাকে লেখক ৭টি পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রথম পর্বের শিরোনাম ‘ঈমান-ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়াবহ এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’। এ পর্বে লেখক হুব্বে রাসূল থেকে মুসলমানদের মন-মানসকে ফিরিয়ে রেখে তাদেরকে আদর্শবিচ্যুত করার পশ্চিমা ষঢ়যন্ত্রের প্রতি আলোকপাত করেছেন। ‘শানে রিসালতে মাআব’ শিরোনামীয় ২য় পর্বে লেখক বিভিন্ন উপশিরোনামে যে সকল বিষয় এনেছেন এর মধ্যে রয়েছে-আল্লাহর কাছে নবীর মর্যাদা, মোহাম্মদী বংশধারার পবিত্রতা, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের বরকত ইত্যাদি।
‘আমার নবী হন গো যেমন, অন্য কেহ নয় কো তেমন’ শিরোনামের তৃতীয় পর্বে লেখক তাফসীরে কুরআনের আলোকে ও যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের বরাতে জামালে মুস্তফা (সা.)-এর কিছু নমুনা তুলে ধরেছেন। এ পর্বে আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে-আকৃতি ও প্রকৃতিতে নবীপাকই সর্বশ্রেষ্ঠ-পূর্ণতম, নবী পাকের সৌন্দর্য, মর্যাদা ও গুণাবলী বেষ্টনীবদ্ধ করা অসম্ভব, নবী পাকের গুণাবলী বর্ণনায় অতিরঞ্জনের মর্মকথা, মোহাম্মদী সৌন্দর্যকে অনুপম জ্ঞান করা ইমানী দাবী, মোহাম্মদী সৌন্দর্যই সৌন্দর্যের মূল মানদন্ড, নবী পাকের সৌন্দর্যে ওয়াইস করনী, নবী পাকের বাহ্যিক সৌন্দর্যও চোখ ভরে দেখা সম্ভব নয় ইত্যাদি। এ পর্বে প্রথমেই লেখক রাসূলে খোদা (সা.)-এর সৌন্দর্য বর্ণনায় সকল পর্যায়ের লেখক-সাহিত্যিকদের ব্যর্থতা ও অপারগতার কথা সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়- “হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য বর্ণনায় আধ্যাত্মবাদী ও চক্ষুষ্মানরা নিজেদের লেখনীতে ভাষা-নৈপুণ্যের শৈল্পিক বৈশিষ্টাবলীর সিন্ধু বইয়ে দিয়েছেন, কবিরা দিয়েছেন কাব্যিক রূপ। কিন্তু কেউই এই অনবদ্য শাশ্বত খোদায়ী প্রতীকের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেন নি। শেষ অবধি তাঁদের জন্য অপারগতা ও জ্ঞান-স্বল্পতার স্বীকৃতি ছাড়া কোন উপায় অবশিষ্ট থাকে নি।” রাসূলে পাক (সা.) হলেন সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। আল্লাহর পরেই তাঁর স্থান। তাঁর মর্যাদা ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে অতিরঞ্জনের অর্থ হলো তাঁকে খোদা বা খোদার পুত্র বলা, যেমন খৃষ্টানরা তাদের নবীকে খোদা বা খোদার পুত্র বলেছে। এ অতিরঞ্জন থেকে মুক্ত থেকে নবীর শানে যে কোন গুণ যুক্ত করলেও তা নবীর প্রকৃত মর্যাদার তুলনায় কম হবে। এ বিষয়ে লেখক যে সকল উদ্ধৃতি দিয়েছেন তন্মধ্যে দুটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী (র.) বলেন- “হুযূর পাক (সা.)-এর মর্যাদা ও গুণাবলী পরিবেষ্টন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই হে প্রশংসাকারী! তুমি হুযূর পাক (সা.)-এর প্রশংসা যতই বাড়িয়ে করে থাক না কেন, তা দিয়ে হুযূরের উচ্চমান মর্যাদা ও শান বর্ণনা বাতুলতা মাত্র। কোথায় সুরাইয়া নক্ষত্র আর কোথায় তোমার স্পর্শোন্মুখ হাত!” মুহাদ্দিস  ইমাম মুনাদী (র.) বলেন-  “হুযূর পাক (সা.)-এর আসল হাকীকত তো দূরের কথা, কিঞ্চিৎও যে ক্ষেত্রে বিবৃতি-বদ্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয় সে ক্ষেত্রে এই অসম্ভব সুদূরপরাহত বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা অতিরঞ্জন, যা-ই হোক, তা এক ধরনের অপূর্ণাঙ্গতাজনিত অপরাধও বটে।”
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ভালবাসার প্রয়োজনীয়তা কি’ শিরোনামের ৪র্থ পর্বে লেখক হুব্বে রাসূলের প্রয়োজনীয়তা, এর প্রকৃতি, সুফল ও নবী করীম (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছেন। এ পর্বে লেখক যে সব উপশিরোনাম ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে রয়েছে- নবী প্রেমের মূল তত্ত্ব, প্রেমের হাকীকত,  প্রেমের মূল কারণ কি, উদার মানবতা : নবী পাকের চাইতে বড় কে হতে পারে, নবী পাকই একমাত্র ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য : কি শরীয়তের দৃষ্টিতে কি সৃষ্টির আপন আগ্রহে, নবী পাকের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা সত্য দ্বীনের প্রথম শর্ত, নবী প্রেমের সুফল, জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক দর্শনে সাহাবীরা শীতল করতেন প্রেমানল ইত্যাদি। ‘নবী প্রেমের মূল তত্ত্ব’-এর মধ্যে লেখক হযরত সুফয়ান ছওরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন- ‘নবী-অনুসরণই হল নবীপ্রেম’। এ অংশে লেখকের প্রদত্ত বক্তব্য আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমরা কেবল মুখে নবীপ্রেমের দাবী করি কিন্তু বাস্তব জীবনে নবী করীম (সা.)-এর অনুসরণকে তেমন গুরুত্ব দেই না। প্রকৃত অর্থে আমাদের এ ভালবাসার দাবী যথার্থ নয়। হুব্বে রাসূলের দাবীতে নিজেদেরকে পাকাপোক্ত করতে হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণে আমাদের নিবিষ্ট হতে হবে।
‘নবী পাকের প্রতি খাঁটি প্রেমের পরিচয়’ শীর্ষক ৫ম পর্বে লেখক নবীপ্রেমের ১৩টি শর্ত বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে প্রথম শর্তই হলো প্রেমাস্পদ তথা নবী করীম (সা.)-এর পূর্ণ আনুগত্য। এ ছাড়া অন্যান্য শর্তসমূহ হলো- নবী করীম (সা.)-এর আদেশ মান্য করা, তাঁকে অধিক স্মরণ করা, তাঁর দীদারের তীব্র বাসনা, তাঁর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ, তাঁর নাম উচ্চারণের সময় আদব, ভক্তি ও শ্রদ্ধাবোধ, তাঁর ভাললাগার ব্যক্তিদের ভালবাসা যেমন সাহাবাদের প্রতি ভালবাসা, আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা, মুহাজির ও আনসারদের প্রতি ভালবাসা এবং আরবদের প্রতি ভালবাসা, তাঁর পছন্দনীয় বস্তুর প্রতি ভালবাসা যেমন তাঁর পছন্দনীয়  খাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির প্রতি ভালবাসা, তাঁর অপছন্দের প্রতি ঘৃণাবোধ, তাঁর শত্রুদের প্রতি শত্রুতাপোষণ, কুরআন-হাদীসের প্রতি ভালবাসাবোধ, তাঁর উম্মতদের মঙ্গল কামনা, বিত্তহীনের দরবেশী বেশ পরিগ্রহ করা এবং সর্বোপরি তাঁকে যে কোন দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে জ্ঞান করা। এ পর্বে পরিপূর্ণ প্রেমের পূর্বশর্তের মধ্যে তিনি কাযী আয়ায মালিকী (র.)-এর একটি উক্তি নিয়ে এসেছেন। কাযী আয়ায বলেছেন, কাউকে ভালবাসার অর্থ হলো প্রেমাস্পদের আনুকুল্য ও আনুগত্যকে নিজের জন্য আবশ্যকীয় করে নেয়া। এতদ্ভিন্ন সে তার দাবীতে সৎ হতে পারে না।
৬ষ্ঠ পর্বে লেখক ‘মোস্তাফা সুন্দরের আশেকগণের প্রেম-নমুনা’ শিরোনামে রাসূল (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কিরামের ভালবাসার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরেছেন। সাহাবায়ে কিরামের অনেকেরই অবস্থা এমন ছিল যে তাঁরা রাসূল (সা.)-কে দিনে অন্তত: একবার না দেখলে পাগলপারা হয়ে যেতেন। তাঁকে কখনো বিচলিত বা বিপদগ্রস্থ দেখলে তারা সর্বাধিক বিচলিত হয়ে পড়তেন, আবার তাঁকে নিরাপদ কিংবা হাসোজ্জ্বল দেখলে তারাই সবচেয়ে বেশী খুশী হতেন। এমনকি নিজের পরিবার-পরিজন হারানোরও পর ‘রাসূল (সা.) ভাল আছেন’ এই সংবাদে তাদের সকল বিপদ-আপদ তুচ্ছ হয়ে যেত। ৭ম পর্বে লেখক হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানে সাহাবাদের বেদনা-বিধুর অবস্থার বিবরণ তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর বরাতে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তার বর্ণনাভঙ্গি প্রেমিক হৃদয়ে বেদনার ঝড় তুলে। এ অংশে লেখক হযরত বেলাল (রা.)-এর উন্মত্ত প্রেমের উপাখ্যান, হাস্সান বিন সাবিত (রা.)-এর শোকগাঁথাসহ কয়েকজন সাহাবীর বিরহ-কাতর অবস্থা বর্ণনার পাশাপাশি নবী-বিরহে শুকনো কাষ্ঠ, খেজুর বৃক্ষ ও ভারবাহী পশুর অবস্থা কী হয়েছিল তাও তুলে ধরেছেন।  সবশেষে পরিশিষ্টাংশে লেখক হুব্বে রাসূলকে যারা ‘পাগলামো’ বা অতিরঞ্জন বলে থাকে তাদের কথার একটি সূক্ষ কারণ বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসূল (সা.)-কে ‘সকল সুন্দরের প্রাণ’, ‘বাস্তব সুন্দরের সত্যরূপ-মূতি’ আখ্যায়িত করে বলেন, “সকল সুন্দরের প্রাণ, বাস্তব সুন্দরের সত্যরূপ-মূতি থেকে আমরা চোখ ফিরিয়ে রেখেছি। সেই জগৎ-প্রেমাস্পদের ভালবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখবার কারণে আমাদের দিবস-রজনীগুলো তমসাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। অনুগ্রহ ও কৃতজ্ঞতার সেই উৎসমূল থেকে আমাদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ কারণেই তো আমাদের কাছে এসব এশ্্ক ও ভালবাসাপূর্ণ কথাগুলো এবং নবী বিরহের শোকগাঁথাগুলো কখনো পৌরাণিক কথা বলে মনে হয়, আবার কখনো প্রাচীন যুগের কল্পকাহিনী বলে ধারণা হয়। আফসোস! শত আফসোস!! আমরা যদি অন্তত হযরত বেলাল (রা.)-এর নবী-প্রেম দেখে নিতাম, আবূ বকর সিদ্দীকের এশকের উন্মাদনার কথা জানতে পারতাম...নিদেনপক্ষে খেজুর বৃক্ষের শুকনো কান্ডের আহাজারী ও ডুকরে উঠা ক্রন্দনের দৃশ্য অনুধাবন করতে পারতাম, তা হলে এশ্কে রাসূলকে ‘পাগলামো’ ও ‘অতিরঞ্জন’ বলে কিছু কিছু লোকের মতো উড়িয়ে দিতে পারতাম না।”
ড. তাহের আল কাদেরীর ‘এশকে রাসূল’ একটি অনবদ্য গ্রন্থ। এর পাতায় পাতায় লেখক প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি ও মহা-মনীষীদের বাণী উদ্ধৃত করে এশকে রাসূলের প্রয়োজনীয়তা ও প্রকৃতি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। স্থানে স্থানে ব্যবহার করেছেন কালোত্তীর্ণ আরবী ও উর্দু কবিতার পংক্তিমালা। বিশেষত: বার বার আল্লামা ইকবালের কাব্য-পংক্তির উদ্ধৃতি এতে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে। এর পরিসর বড় না হলেও এশকে রাসূল ও এর প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী সবই এতে উঠে এসেছে। যেন বিন্দুর মাঝে সিন্ধুকে ধারণ করা হয়েছে। বাংলাভাষায় অনূদিত এ গ্রন্থটির শুরুতে রয়েছে ‘সম্পাদকের কিছু কথা’ ও ‘প্রকাশকের বক্তব্য’। মূল উর্দু গ্রন্থের শুরুতে রয়েছে আলী আকবর কাদেরী’র লেখা ‘প্রাককথন’। বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন মাওলানা মীর জাভেদ ইকবাল। অনুবাদক লেখকের মূলভাব ও সাহিত্যমান বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বৃহদাংশে সফল হলেও কখনো কখনো শব্দপ্রয়োগে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে আরবী ও উর্দু কাব্য-পংক্তিমালার কাব্যানুবাদ করা হয়েছে। তবে কাব্যানুবাদ আরো মানোত্তীর্ণ হলে ভাল হতো।  বইটির অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন আবূ আহমেদ জামেউল আখতার চৌধুরী। এটি প্রকাশক করেছেন সঞ্জরী পাবলিকেশনের মোহাম্মদ আবূ তৈয়ব চৌধুরী। প্রকাশকাল-এপ্রিল ২০০৯। বইটির প্রচ্ছদ মোটামুটি, ছাপা ও বাঁধাই ভাল। মূল্য- ১৬০/= (একশত ষাট টাকা)।

(সূত্র : সাপ্তাহিক পূর্বদিক, সূচনা সংখ্যা, ১০ অক্টোবর ২০১১)

বৃহস্পতিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বই পরিচিতি : শবে বরাত


শবে বরাত By মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

লেখক : মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
প্রকাশক :  সয়লাব প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০১৩ ঈসায়ী
মূল্য : ৯৫/- (পঁচানব্বই টাকা মাত্র)

শবে বরাত এক বরকতময় ও ফযীলতপূর্ণ রাত। ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে অদ্যাবধি এ রাত মুসলিম উম্মাহর নিকট বৈশিষ্ট্যময় রাত হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমান সময়ে কিছু লোক কেবল সহীহ হাদীসের দোহাই তোলে এবং উলামা-মুহাদ্দিসীন ও সলফে সালিহীনের বক্তব্যের মর্ম অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে শবে বরাতের ফযীলত অস্বীকারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিজস্ব বিবেচনায় সহীহ ও হাসান স্তরের বিভিন্ন হাদীসকে যঈফ এমনকি মাওযূ বলতেও দ্বিধাবোধ করছে না। নানা ধরনের বইপত্র রচনা ও প্রকাশ করে এবং পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে শবে বরাত সম্পর্কে তারা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এ সকল অপপ্রচারের জবাবে বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসার আরবী প্রভাষক মাওলানা মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান কৃত ‘শবে বরাত’ একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এতে শবে বরাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে তাফসীর, হাদীস ও ফিকহের গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত অনেক বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবীরা শবে বরাতের কোনো ভিত্তি নেই বলে অপপ্রচার চালায়। তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে লেখক তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব শায়খ ইবনে তায়মিয়া, আব্দুর রাহমান মুবারকপুরী, নাসির উদ্দিন আলবানী প্রমুখের অভিমত এতে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন। বইটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায় শা’বান মাসের ফযীলত, দ্বিতীয়  অধ্যায় শবে বরাতের ফযীলত, তৃতীয় অধ্যায় তাফসীর গ্রন্থসমূহে শবে বরাত, চতুর্থ অধ্যায় শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ, এতে বর্ণিত হাদীসসমূহের সনদের পর্যালোচনাও রয়েছে, এবং পঞ্চম অধ্যায় শবে বরাত সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি ও এর জবাব। লেখক এধ্যায়ে চারটি বিভ্রান্তির বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। যেমন- প্রথম বিভ্রান্তি : কুরআন ও হাদীসে শবে বরাতের উল্লেখ নেই, দ্বিতীয় বিভ্রান্তি : শবে বরাত সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস নেই, তৃতীয় বিভ্রান্তি : শবে বরাতকে ভাগ্য রজনী বলা যাবে না এবং চতুর্থ বিভ্রান্তি : শবে বরাতের প্রচলন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে হয়নি। বর্ণিত শিরোনামে লেখক এ সকল বিভ্রান্তির যথাযথ জবাব দিয়েছেন। কলেবর ছোট হলেও এ গ্রন্থটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণসমৃদ্ধ। আমরা এ গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করছি।
- মোহাম্মদ আলী

বই পরিচিতি : চল্লিশ হাদীস


লেখক : মাওলানা মোঃ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
প্রকাশনায়: ফুলতলী পাবলিকেশন্স, জকিগন্জ, সিলেট
প্রকাশকাল: মার্চ ২০১২ ঈসায়ী, রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরী



দ্বীনী বিষয় সম্পর্কে চল্লিশটি হাদীস নিয়ে কিতাব সংকলন বুযুর্গানে কিরামের অন্যতম রীতি। এ রীতির অনুসরনে ইমাম বুখারী (র.)-এর সহীহ বুখারী থেকে নির্বাচিত চল্লিশ হাদীস নিয়ে একটি কিতাব সংকলন করেছেন মুজাদ্দিদে যামান, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী মুরশিদে বরহক হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী (বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী)। এ কিতাবে লেখক যে সব বিষয়ে হাদীস সন্নিবেশিত করেছেন করেছেন তা হলো- জুমআর দিন গোসলের গুরুত্ব, জামাতে নামাযের ফযীলত, নামাযে কাতার সোজা করা জরুরি, নামাযের দ্বারা গোনাহ মাফ হয়, শয়তানের গিরা, ইসলামের বুনিয়াদ, বিধবা ও মিসকিনকে সাহায্য করার ফযীলত, সূরা ফাতিহার মরতবা, আমিন বলার ফযীলত, সূরা এখলাসের ফযীলত, মুয়াযযিনের মর্যাদা, যিক্রের ফযীলত, সায়্যিদুল ইস্তিগফার, তাহলিলের ফযীলত, জান্নাতের শুভ সংবাদ, জান্নাতের আশা, নেক ইরাদার ফল, উত্তম আকাক্সক্ষা, ঘুমাইবার পূর্বে দু‘আ, সুস্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন, স্বপ্নে রাসূল (সা.)-এর দীদার লাভ, সাহাবাগণের মর্যাদা, সাহাবা, তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের মর্যাদা, দু‘আ কবূল হওয়ার জন্য জরুরি বিষয়, এতীম প্রতিপালনের সুফল, নি¤œস্তরের মানুষের প্রতি দৃষ্টিপাত, এমন হও যেমন একজন অজ্ঞাত পরিচয় মুসাফির, অন্ধ ব্যক্তির ধৈর্যধারণের সুফল, মধুর উপকারিতা, মায়ের হক, বৃক্ষরোপণের ফযীলত, বৃদ্ধের মনে দুনিয়ার মোহ, ক্ষুদ্র অপরাধ থেকে দূরে থাকা, যবান, মেহমান ও প্রতিবেশীর হক, আজওয়া খেজুরের গুণ, জুতা পরার নিয়ম,প্রকৃত ধনবান ব্যক্তি, সায়্যিদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দৃষ্টিতে দুনিয়ার সম্পদ, আমানতের যিম্মাদারের সওয়াব এবং হযরত ফাতিমা (রা.)-এর শান।
কিতাবের শুরুতে রয়েছে লেখকের ‘ভূমিকা’। শেষে পরিশিষ্ট অংশে লেখকের রচিত অন্যান্য গ্রন্থ থেকে কয়েকটি বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। এ অংশে রয়েছে- হাদীস শরীফের অনুবাদ পাঠকারীগণের প্রতি নিবেদন, হাদীস তলবের উদ্দেশ্যে সফর, মুরাকাবা, সাহাবায়ে কিরামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের প্রতি, সাহাবাগণের শত্রুর পরিণাম, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহব্বতের বাঁধনে যায়েদ বিন হারিসা রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিয়ারতের গুরুত্ব, ইমাম আযম (র.)-এর যিয়ারতে ইমাম শাফী (র.), বেহেশতের খেজুর গাছ, মাতৃ অভিশাপ, রাহমাতুল্লিল আলামিনের মুবারক হাতের পরশ, মহাসত্য প্রকাশিত হল ইঞ্জিল বারনাবাস থেকে, মধুর উপকারিতা, ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.) সম্পর্কে কিছু কথা এবং অন্তিম ইচ্ছা।
এ কিতাবটিতে উল্লেখিত প্রত্যেক হাদীসের সাথে বাংলা অনুবাদ রয়েছে। এটি সর্বস্তরের পাঠকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

-মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান