মঙ্গলবার, ২ জুন, ২০১৫

শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফযীলত

মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দার প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। তিনি কোনো না কোনো উপলক্ষ ধরে আপন বান্দাকে ক্ষমা করতে চান। বিশেষত উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি তিনি অত্যন্ত অনুগ্রহপরায়ন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত যাতে অল্প সময়ে অধিক কুরবত ও সফলতা অর্জন করতে পারে সে লক্ষ্যে তাদের জন্য তিনি বরকতময় বিভিন্ন দিন ও সময় নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যে রাতকে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতও বিশেষ ফযীলতপূর্ণ রাতের মধ্যে একটি। আমাদের দেশে এ রাত ‘শবে বরাত’ নামে পরিচিত। এর আরবী পরিভাষা ‘লাইলাতুল বারাআত’ অর্থাৎ মুক্তির রজনী। হাদীস শরীফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’ অর্থাৎ শা’বানের মধ্যবর্তী রাত বলা হয়েছে। সহীহ হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন অতঃপর মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। মুমিনদের জন্য কল্যাণের বার্তাবাহী যে সকল দিবস-রজনী রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটির বর্ণনা সরাসরি কুরআন মজীদে এসেছে। আবার কোনো কোনোটির বর্ণনা সরাসরি কুরআন মজীদে নেই, তবে তা হাদীসে নববীতে রয়েছে। শবে বরাতের বর্ণনা সরাসরি কুরআন মজীদে পাওয়া যায় না। তবে পবিত্র আল কুরআনুল কারীমের সূরা দুখানের তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে বর্ণিত রাতকে কোনো কোনো মুফাসসির শবে বরাত বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা দুখানের আয়াত দুটি হচ্ছে- মহান আল্লাহ রাব্বুল ্আলামীন ইরশাদ করেন : “আমি এটি (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। আমি তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।” (সূরা দুখান, আয়াত ৩-৪) এখানে উল্লেখিত ‘বরকতময় রজনী’র ব্যাখ্যায় হযরত ইকরামা ও একদল মুফাসসির বলেছেন, এ রাত হলো শবে বরাত। তাফসীরে রূহুল মা‘আনীসহ বিভিন্ন তাফসীরে উল্লেখ আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.), কাতাদাহ, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র, মুজাহিদ, ইবনে যায়দ, হাসান বসরীসহ জমহুর মুফাসসিরীনের মতে, বরকতময় রজনী বলতে শবে কদর উদ্দেশ্য। ইমাম কুরতুবী, আল্লামা ইবনে কাসীর, আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম রাযী, আল্লামা মাহমুদ আলুসী বাগদাদী, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীসহ প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ স্ব-স্ব তাফসীর গ্রন্থে “বরকতময় রাত্রির” ব্যাখ্যায় পূর্বসূরী মুফাসসিরদের থেকে বর্ণিত দুটি মতই (শবে কদর ও শবে বরাত) উল্লেখ করেছেন। জমহুর মুফাসসিরীনের বর্ণনা অনুযায়ী ‘বরকতময় রজনী’ বলতে শবে বরাত উদ্দেশ্য না হলেও তাঁদের বিভিন্ন বর্ণনায় শবে বরাতের বিশেষত্বের দিক পরিলক্ষিত হয়। যেমন তাফসীরে রূহুল মাআনীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, সকল বিষয় সিদ্ধান্ত হয় শা’বান মাসের মধ্যরাতে অর্থাৎ শবে বরাতে এবং এগুলো সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় রামাদান মাসের ২৭ তম রাতে অর্থাৎ শবে কদরে (তাফসীরে রূহুল মাআনী, খ- ২৫, পৃষ্ঠা ১১৩)। বিভিন্ন তাফসীরে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’-এর ব্যাখ্যায় শবে কদরের পাশাপাশি মুফাসসিরীনে কিরাম শবে বরাত প্রসঙ্গে যে আলোচনা করেছেন এবং এর সপক্ষে যে সকল হাদীস এনেছেন তা থেকেই শবে বরাতে সবিশেষ ফযীলত প্রমাণিত হয়। শবে বরাত সম্পর্কে হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সহীহ ইবনে হিব্বান-এর মধ্যে রয়েছে- হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক অথবা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান (অখ-) পৃষ্ঠা ১৫১৪, হাদীস নং ৫৬৬৫) সহীহ ইবনে হিব্বান ছাড়াও ইমাম বায়হাকী’র শুয়াবুল ঈমান, ফাদ্বাইলুল আওকাত, ইমাম তাবারানী’র আল মুজামুল কাবীর, আল মুজামুল আওসাত, হাফিয আল মুনযিরী, আত তারগীব ওয়াত তারহীবসহ বিভিন্ন হাদীসগন্থে এ হাদীসটি রয়েছে। শায়খ নাসিরউদ্দিন আলবানী যিনি পূর্বসূরী মুহাদ্দিসীনে কিরামের নীতি-আদর্শকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব বিবেচনায় বহু সহীহ হাদীসকে যঈফ এমনকি মাওযূ পর্যন্ত বলেছেন, বুখারী ও মুসলিম ছাড়া সিহাহ সিত্তাহ’র অন্য কিতাবসমূহকে সহীহ ও যঈফ এ দুভাগে বিভক্ত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন তিনিও তার‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা’ গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এ হাদীস সম্পর্কে তার মন্তব্য হলো- এ হাদীসটি সহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে, যা একে অন্যকে শক্তিশালী করে। এ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কিরাম হলেন- ১. হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) ২. আবূ সা’লাবা আল খুশানী (রা.) ৩. আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ৪. আবূ মূসা আল আশআরী (রা.) ৫. আবূ হুরায়রাহ (রা.) ৬. আবূ বকর (রা.) ৭. আউফ ইবনে মালিক (রা.) ৮. হযরত আয়িশাহ (রা.)। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা, খ- ৩, পৃষ্ঠা ১৩৫, হাদীস নং ১১৪৪) হযরত আবূ সা’লাবা আল খুশানী (রা.) বর্ণিত হাদীসে আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৮১) নাসির উদ্দিন আলবানী তদীয় সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব এর মধ্যে হাদীসটিকে ‘সহীহ লিগাইরিহি’ বলেছেন (খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৪, হাদীস নং ২৭৭১) এবং সহীহ জামিউস সগীর ওয়া যিয়াদাতুহু-এর মধ্যে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন (খ- ১, পৃষ্ঠা ১৩৭)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (শবে বরাত) আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। তবে দুপ্রকার ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। ১. হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ২. মানুষ হত্যাকারী (মুসনাদে আহমদ, খ- ১১, পৃষ্ঠা ২১৬)। হাফিয আল মুনযিরী বলেছেন, ইমাম আহমদ (র.) হাদীসটি দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন। এর জবাবে নাসির উদ্দিন আলবানী বলেছেন : এ হাদীসের সমর্থনে রশীদ ইবনে সা’দ ইবনে হুয়াই এর হাদীস রয়েছে। সুতরাং হাদীসটি হাসান। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ, খ- ৩ পৃষ্ঠা ১৩৫) শুআইব আল আরনাউত মুসনাদে আহমদ-এর তা’লীকে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। হযরত আবূ মুসা আল আশ‘আরী (রা.) বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক অথবা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা ৪৪৫) নাসির উদ্দীন আলবানী তদীয় ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ’-এর মধ্যে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তিনি তদীয় সহীহ ইবনে মাজার মধ্যে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন এবং সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীবের মধ্যে হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন : হাদীসটি সহীহ লিগাইরিহি। ইমাম ইবনে মাজা স্বীয় শব্দে আবূ মুসা আশআরী (রা.) থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। (সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৩, হাদীস নং ২৭৬৮) হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক অথবা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৮০) এ হাদীসটির সনদ সম্পর্কে হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী বলেন, হাদীসটি বায্্যার ও বায়হাকী এমন সনদে বর্ণনা করেছেন যার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই। শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী তদীয় সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব-এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন, হাদীসটি সহীহ লি গাইরিহি। বায্্যার ও বায়হাকী আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)-এর সূত্রে এমন সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন যাতে কোন অসুবিধা নেই। (সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৪, হাদীস নং ২৭৬৯) হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। বাকী নামক কবরস্থানে তাঁকে পেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি আশংকা করছ যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমাণের চেয়েও অধিক পরিমাণ লোকদের ক্ষমা করেন (তিরমিযী, খ- ৩, পৃষ্ঠা ১১৬; মুসনাদে আহমদ, খ- ৪৩, পৃষ্ঠা ১৪৬)। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইবনে মাজা, আবূ বকর ইবনে আবি শায়বা, ইমাম বায়হাকী, ইমাম বাগাভী (র.) এর মতো প্রখ্যাত মুহাদ্দিসীনে কিরাম স্ব স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন কিন্তু কেউই একে যঈফ বা দুর্বল বলে অভিহিত করেননি। আর ইমাম ইবনে হিব্বান (র.) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। এছাড়া হাদীসটি উরওয়া ইবনে যুবায়র-এর সনদ ছাড়াও আরো চারটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। আর একাধিক সূত্রে বর্ণিত হবার কারণে এটি সহীহ লি গাইরিহী অথবা হাসান এর পর্যায়ভুক্ত। উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, শবে বরাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে কমপক্ষে ত্রিশজন সাহাবীর বর্ণনা রয়েছে। হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন শা’বানের মধ্যবর্তী রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিনে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন : আছো কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছো কি কোনো রিয্ক প্রার্থনাকারী? আমি রিয্ক দান করব। আছো কি কোনো বিপদে নিপতিত ব্যক্তি? আমি সুস্থতা দান করব। আছো কি এমন? আছো কি এমন? এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা ৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮) উসমান ইবনে মুগীরা ইবনে আখনাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক শা’বান থেকে পরবর্তী শা’বান পর্যন্ত জীবনকাল নির্ধারিত হয়। এমনকি একজন মানুষ বিয়ে করে, তাঁর সন্তান হয় অথচ তার নাম মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় বের করে রাখা হয়ে গেছে। (শুআবুল ঈমান, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৮৬) হযরত উসমান ইবনে আবিল আস (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন শা’বানের মধ্যবর্তী রাত (শবে বরাত) আসে তখন আল্লাহ পাক এই বলে আহবান করেন, তোমাদের মধ্যে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো প্রার্থনাকারী কি আছে? আমি তার চাহিদা পূর্ণ করে দেব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যেই চাইবে তাকে দান করা হবে, কেবল ব্যভিচারিনী ও মুশরিক ব্যতীত। (শুআবুল ঈমান, খ--৩, পৃষ্ঠা-৩৮৩) হযরত আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, শবে কদরের পর সর্বোত্তম রাত হলো শা’বানের মধ্যবর্তী রাত (শবে বরাত)। এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর মুশরিক, হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী অথবা রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্নকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে রজব হাম্বল,ি লাতায়িফুল মা‘আরিফ, পৃষ্ঠা ১৯১) উপরোল্লিখিত হাদীসসমূহের ভাষ্যানুযায়ী শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতে আল্লাহ তা’আলা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া তাঁর সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। একজন মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে? আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত এ ক্ষমা তথা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় এবং তাঁর আরো অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় তাবিঈন, তাবে তাবিঈন ও আইয়্যাম্মায়ে মুজতাহিদ এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত বন্দেগি করেছেন। পাশাপাশি মানুষদের এ রাতে ইবাদত বন্দেগি করতে উৎসাহিত করেছেন। তাদের অনুসরণে আমাদের উচিত হলো নেক আমলের মাধ্যমে এ রাত অতিবাহিত করা। এ রাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের আমল করতে পারি। যেমন- রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত ও তাসবীহ-তাহলীল ও দরুদ শরীফ পাঠ করা, দুআ-ইস্তিগফার করা, মৃত আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমানদের কবর যিয়ারত করা ও তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা , নফল নামায আদায় করা, ১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা ইত্যাদি। মনে রাখা উচিত যে, শা’বান মাস ও মহিমান্বিত শবে বরাত মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের এক অনন্য সুযোগ। সুতরাং এ সময়ে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা আল্লাহর রহমত লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শবে বরাত নিয়ে সমাজে কিছু বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে : ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ ও রাস্তা-ঘাটে আলোকসজ্জা করা, বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা, আতশবাজি করা, পটকা ফোটানো, মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো ইত্যাদি। এ সকল বিদআত ও কুসংস্কার থেকেও আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদেরকে নেক আমলের মাধ্যমে শবে বরাত অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

http://www.sylheterdakbd.com/TheDailySylheterDak/DetailsPage.aspx?PostId=47238&PageId=3

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

শা’বান মাসের ফযীলত


মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

শা’বান এক মহিমান্বিত ও বরকতময় মাস। বছরের অন্যান্য মাসের উপর এ মাসের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব। হাদীস শরীফে আছে যে, প্রত্যেক বছর শা’বান মাসে মানুষের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রজব মাসের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য মাসের উপর এমন, যেমন আল কুরআনুল কারীমের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য আসমানী গ্রন্থের উপর। আর শা’বান মাসের ফযীলত অন্যান্য মাসের উপর এমন, যেমন আমার মর্যাদা অন্যান্য নবীগণের উপর। আর রামাদানের ফযীলত অন্যান্য মাসের উপর এমন, যেমন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব সকল সৃষ্টির উপর। (হযরত আবদুল কাদীর জিলানী (র.), গুনিয়াতুত তালিবীন, পৃষ্ঠা ২৪৬)
হযরত জুন্নুন মিসরী (র.) বলেন, রজব হচ্ছে মন্দ কাজ পরিত্যাগের মাস, শা’বান হচ্ছে ইবাদত করার মাস এবং রামাদান হচ্ছে অলৌকিক দৃশ্য দর্শনের মাস। সুতরাং যে ব্যক্তি মন্দ কাজ পরিত্যাগ করে না, আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে না এবং অলৌকিকতা দর্শনের অপেক্ষায় থাকে না, সে অনর্থক কর্মসম্পাদনকারীদের পর্যায়ভূক্ত। তিনি আরও বলেন, রজব মাসে শস্য বপন করা হয়, শা’বান মাসে ক্ষেতে পানি সেচ করা হয় এবং রামাদান মাসে ফসল কর্তন করা হয়। সুতরাং কর্তনকারী ঐ বস্তুই কর্তন করে, যা সে বপন করে থাকে। এজন্য মানুষ যা কিছু করে থাকে, তারই প্রতিফল পায়। যে ব্যক্তি নিজের ক্ষেত বিনষ্ট করে, সে ফসল কর্তনের সময় লজ্জিত হয় এবং এর পরিণতিও খারাপ হয়। (গুনিয়াতুত তালিবীন, পৃষ্ঠা ২৩৫)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাস শা’বান
শা’বান মাসের অত্যধিক ফযীলতের কারণে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসকে তাঁর নিজের মাস বলে অভিহিত করেছেন। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-রামাদান আল্লাহর মাস এবং শা’বান আমার মাস। শা’বান পবিত্রতা দানকারী আর রামাদান গুনাহমোচনকারী। (কানযুল উম্মাল, খ- ৮, পৃষ্ঠা ৭৪৭, হাদীস নং-২৩৬৮৫, ইবনে আসাকির, দায়লামী, আল জামিউস সগীর লিস সুয়ূতী)
শা’বান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাস হওয়ার কারণ হলো তিনি এ মাসে আবশ্যকতা ছাড়া অর্থাৎ নফল হিসেবে অধিক রোযা রাখতেন। আর রামাদান আল্লাহর মাস হওয়ার কারণ হলো আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে রোযা রাখা ফরয করে দিয়েছেন। ফলে এ মাসে রোযা রাখা বান্দার প্রতি আল্লাহর হক হিসেবে পরিগণিত। (ফায়যুল কাদীর লিল মানাভী, খ--১৪, পৃষ্ঠা ৪০৫)

শা’বান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক পরিমাণে রোযা রাখতেন
শা’বান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক পরিমাণে রোযা রাখতেন। হাদীস শরীফে আছে- হযরত আবূ সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়িশা (রা.) তাঁকে বর্ণনা করেছেন, আয়িশা (রা.) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা’বানের চেয়ে অধিক রোযা অন্য কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি পূরো শা’বানই রোযা রাখতেন। আর তিনি বলতেন, তোমরা সাধ্যমতো আমল কর। কেননা আল্লাহ তাআলা অধিক আমলের সওয়াব দিতে অপারগ হবেন না, তবে তোমরা অধিক আমল করতে অপারগ হয়ে পড়বে। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পছন্দনীয় নামায হলো সেই নামায যা নিয়মিত আদায় করা হয়, যদিও তা কম হয়। যখন তিনি কোনো নামায আদায় করতেন তখন তা নিয়মিত করতেন। (বুখারী) এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো শা’বানই রোযা রাখতেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি শা’বানে সামান্য দিন ছাড়া সবদিনই রোযা রাখতেন। (মুসলিম)
হযরত আয়িশা (রা.) বর্ণিত অপর হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে রোযা রাখা আরম্ভ করতেন যে আমরা বলতাম তিনি আর রোযা বাদ দিবেন না। আর যখন রোযা বাদ দিতেন তখন আমরা বলতাম তিনি আর রোযা রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রামাদান ছাড়া অন্য কোনো মাসে রোযা পূর্ণ করতে দেখিনি এবং শা’বান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে অধিক রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারী)
এ সকল হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা’বান মাসে অধিক রোযা রাখতেন। এর অন্যতম কারণ হলো, মানুষ রজব ও রামাদান মাসকে অধিক গুরুত্ব দেয়। আর মধ্যখানে শা’বান মাসকে ভুলে যায়। ফলে এ মাসে ইবাদত বন্দেগি কম করে। অথচ এ মাসে মানুষের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাইতেন তাঁর আমল রোযাদার অবস্থায় আল্লাহর নিকট পেশ করা হোক। তাই তিনি এ মাসে অধিক রোযা রাখতেন।
হযরত উসামা ইবনে যায়দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনাকে একটি মাসে যেমন রোযা রাখতে দেখি তেমন অন্য কোনো মাসে দেখি না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন মাসে? আমি বললাম, শা’বান। তিনি বললেন, শা’বান হলো রজব ও রামাদান মাসের মধ্যবর্তী মাস। মানুষ এ মাস সম্পর্কে গাফিল থাকে। অথচ এ মাসে বান্দার আমল (আল্লাহর দরবারে) উঠানো হয়। সুতরাং আমি পছন্দ করি যে, আমার আমল রোযাদার অবস্থায়ই উঠানো হোক। আমি বললাম, আপনি তো সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখেন। এ দুটিও কি আপনি ছাড়েন না? তিনি বললেন, বান্দার আমল (এ দুই দিনও আল্লাহর দরবারে) উঠানো হয়। সুতরাং আমি পছন্দ করি যে আমার আমল রোযাদার অবস্থায়ই যেন উঠানো হয়। (বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৭৭, হাদীস নং ৩৮২০)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসের পর শা’বান মাসের রোযাকে সর্বোত্তম রোযা বলে অভিহিত করেছেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো- রামাদানের পর কোন রোযা উত্তম? তিনি বললেন, রামাদানের সম্মানার্থে শা’বানের রোযা। বলা হলো- কোন সদকা উত্তম? তিনি বললেন, রামাদানের সদকা। ইমাম তিরমিযী (র.) বলেন, এ হাদীসটি গরীব (غريب)। (তিরমিযী)

শা’বান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের আমল
পূর্বোল্লিখিত হাদীসমূহ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা’বান মাসে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে রোযা রাখতেন। তিনি এমনভাবে রোযা রাখতেন মনে হতো যেন আর কখনো রোযা বাদ দিবেন না। বুখারী শরীফে আছে, তিনি পুরো শা’বানই রোযা রাখতেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি সামান্য কিছু দিন ছাড়া পুরো শা’বানই রোযা রাখতেন (মুসলিম)।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রজব মাস শুরু হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু‘আ করতেন : “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাদ্বান” অর্থাৎ হে আল্লাহ! রজব ও শা’বান মাসে আমাদের বরকত দান কর এবং আমাদের রামাদান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দাও। (আল আয্্কার লিন নববী, মুজামুল আওসাত লিত তাবারানী)

সাহাবায়ে কিরামও এ মাসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। এ মাসে তাঁরা কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমলে সবিশেষ মনোনিবেশ করতেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ যখন শা’বান মাসের চাঁদ দেখতেন তখন তাঁরা কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হতেন। মুসলমানগণ তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করতেন, যাতে দুর্বল ও অভাবগ্রস্ত লোকজন রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন। আমীরগণ বন্দীদের তলব করতেন। কারো উপর কোনো হদ (শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি) থাকলে তা প্রয়োগ করতেন অন্যথায় মুক্ত করে দিতেন। ব্যবসায়ীগণ এ মাসে তাদের ঋণ পরিশোধ করতেন। অতঃপর ব্যবসা গুটিয়ে নিতেন। রামাদানের চাঁদ দেখার পর তারা গোসল করতেন এং দুুনিয়াবী কাজ থেকে বিরত থাকতেন। (গুনিয়াতুত তালিবীন, পৃষ্ঠা ২৪৬)

রামাদান মাসের প্রস্তুতির মাস শা’বান
শা’বান মাস মূলত: রামাদান মাসের প্রস্তুতির সময়। এ মাস অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এ মাসের আলাদা সম্মান ছিল। এর কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে-

প্রথমত : এ মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। যার বর্ণনা আগে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত : রামাদান হলো রহমত, বরকত ও মাগফিরাত অর্জনের মাস। যে সকল বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন কল্যাণ প্রত্যাশা করেন তারা রামাদান মাসের রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও দোযখ থেকে মুক্তির কল্যাণবারিতে নিজেকে সিক্ত করতে চেষ্টা-প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন। তারা রামাদান মাসে দিনে সিয়াম সাধনায় মনোনিবেশ করেন আর রাত্রিবেলা ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করেন এবং এর বিনিময়ে মাগফিরাত প্রত্যাশা করেন। কেননা হাদীস শরীফে আছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় রামাদানের রোযা রাখে তার পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় শবে কদরে রাত্রি জাগরণ করে তার পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী)
হাদীস শরীফে আরও আছে- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় রামাদান মাসে রাত্রি জাগরণ করে তার পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য হাদীসে আছে- যখন রামাদান মাসের প্রথম রাত আসে তখন শয়তান ও জ্বিনদের শৃঙ্খলবদ্ধ করা হয়, দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এমতাবস্থায় আর কোনো দরজা খোলা হয় না এবং বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় তখন আর কোনো দরজা বন্ধ করা হয় না। আর একজন আহবানকারী আহবান করেন : ‘হে কল্যাণপ্রত্যাশী অগ্রসর হও, হে মন্দপ্রত্যাশী সংকুচিত হও। আল্লাহর এমন অনেক বান্দা রয়েছেন যারা দোযখের আগুন থেকে মুক্তি লাভ করবে।’ এ অবস্থা (রামাদান মাসের) প্রত্যেক রাতে চলতে থাকে।(তিরমিযী)
রামাদান মাসের এসব কল্যাণ অর্জন তথা যথাযথ হক আদায় করে রোযা রাখা ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মহান নিয়ামত অর্জন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া সম্ভব হবে না। এ প্রস্তুতির মাস হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা’বান মাসকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন।
তৃতীয়ত : রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের গাফলতের সময়কে আনুগত্য ও মুজাহাদা (ইবাদত-বন্দেগির প্রচেষ্টা) দ্বারা আবাদ করতে চাইতেন, যাতে তারা পরবর্তী মাসের রহমত ও মাগফিরাত থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত না হয়। কেননা শা’বান মাসে গাফিল থাকলে এমনও হতে পারে যে রামাদান মাসটাও গাফলতের মধ্যে চলে যাবে এবং বান্দা পরে আফসোস করবে- হায়! রামাদান মাস তো চলে গেল, আমি তো কোনো কল্যাণ অর্জন করতে পারলাম না। আর রামাদান মাসের কল্যাণ থেকে যে বঞ্চিত হয় তার মতো হতভাগা আর কে হতে পারে? তাই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসের নিয়ামত থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হবার সুযোগ যাতে সৃষ্টি না হয় বরং এর পরিপূর্ণ নিয়ামত যাতে অর্জন করা যায় সেজন্য পূর্ব প্রস্তুতির মাস হিসেবে শা’বানকে গুরুত্ব প্রদান করতেন এবং এ মাসে ইবাদত-বন্দেগি ও সিয়াম সাধনায় মনোনিবেশ করতেন।

শা’বান মাসের সবিশেষ গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর অনুসরণে এ মাসে অধিক পরিমাণে রোযা রাখা এবং কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিতে অধিক মনোনিবেশে আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত, যাতে আগত রামাদানের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত অন্বেষণে আমরা পরিপূর্ণরূপে নিবিষ্ট হতে পারি এবং পরম দয়াময়ের সীমাহীন অনুগ্রহ লাভ করে ধন্য হই।
 

মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০১৫

বিপদ-আপদে আমাদের তাওবাহ-ইসতিগফার করতে হবে


মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের উপমহাদেশে ঘটে যাওয়া ভুমিকম্পে আমাদের পার্শবর্তী দেশ নেপালে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবাণী আমাদের মাতৃভুমিতে কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
ভুমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বিপদ-আপদের কারণ কি? মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ.
-তোমাদের উপর যে বিপদ পতিত হয় না কেন সেটা তোমাদের কৃতকর্মের ফল। তদুপরি তিনি অনেক বিষয় ক্ষমা করে দেন। (আল-কুরআন, সূরা আশ শূরা, আয়াত নং-৩০)
আমাদের নবীর পূর্বে যে সব নবী-রাসূলগণ আগমন করেছেন তাদের উম্মতদেরকে গোনাহ করার সাথে সাথেই শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু আমাদের নবী (সা.)-এর জন্য মহান আল্লাহ আমাদের উপর ইহসান করেছেন। তিনি তার রাসূল (সা.) কে বিশেষ্যত্ব দান করেছেন। যার জন্যে আমরা গোনাহ করার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে গযব দিয়ে ধ্বংস করেন না। মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবীব (সা.) কে উদ্দেশ্য করে ঘোষনা করেন- وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ
(হে নবী) আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দিব না যতক্ষন আপনি পৃথিবীতে থাকবেন। মুফাচ্ছিরীনে কেরাম বলেন- আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে কোন নবীর উপস্থিতিতে তাঁর জাতিকে শাস্তিদেন না। শাস্তি দিতে হলে সে নবীকে সরিয়ে নিয়ে শাস্তি নাযিল করেন। যেমন নূহ (আ.)-এর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি।
উক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশ হলো- وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
-আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যতক্ষণ তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
সুতরাং ভুমিকম্প বা অন্যান্য যে কোন বালা-মসীবতে আমাদেরকে ইসতেগফার করতে হবে। আমাদের গোনাহর জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে।
ইসতেগফার ও যিকিরের অভ্যাস গড়ে তুলা উচিত। কেননা সাধারণত আমরা যখন বিপদের মধ্যে পরি তখন আমদের সবচেয়ে চর্চিত বিষয়গুলো মনে পড়ে। আমার এক হুযুর আমাদেরকে বলেছেন তিনি একবার গাড়ি এক্সিডেন্ট করেন। গাড়ি থেকে নামার পরে এক লোক বললেন-আমি অনেক চেষ্টা করেও কালিমাটা স্মরণ করতে পারিনি।ন্তু আশ্চর্য তিনি মনেই করতে পারেন নি। একই গাড়ীতে এক মহিলা ছিলেন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। স্ট্রেচারে করে তাকে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বেহুশ অবস্থায় পড়তে লাগলেন- حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
মানুষ যখন বেশি পাপ করে তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সতর্ক করার জন্যেও বালা-মসীবত দান করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وما نرسل بالآيات إلا تخويفاً আমি ভয় দেখানোর জন্যই নিদর্শন পাঠিয়ে থাকি।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করে দেন। কিয়ামতের কথা স্মরণ করে দেন।
বিপদের সময় আমাদের করণীয় কি? হাদীস শরীফে এসেছে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যখন তোমরা বিপদাপদে পতিত হও তখন তোমরা ইসতিগফার করো, দূর্বলদেরকে সহায়তা করো।
فإذا رأيتم ذلك فافزعوا إلى ذكر الله ودعائه واستغفاره.
আমাদের সমাজে যারা খারাপ কাজ করে তাদেরকে বাধা দেওয়া উচিত। কেননা খারাপ কাজের বাধা না দিলে যারা সৎকর্মশীল আছেন তারাও বিপদে পতিত হবেন। তিরমিযী শরীফে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
مثل القائم على حدود الله والمدهن فيه كمثل قوم استهموا على سفينة في البحر فأصاب بعضهم أعلاها وأصاب بعضهم أسفلها فكان الذين في أسفلها يصعدون فيستقون الماء فيصبون على الذين في أعلاها فقال الذين في أعلاها لا ندعم تصعدون فتؤذوننا فقال الذين في أسفلها فإننا ننقبها من أسفلها فنستقي فإن أخذوا على أيديهم فمنعوهم نجوا جميعا وإن تركوهم غرقوا جميعا.
-আল্লাহর বিধান পালনকারী এবং অবহেলাকারীদের মধ্যে দৃষ্ঠান্ত হলো একটি জাহাজের আরোহীদের মতো। যারা লটারীর মাধ্যমে দুই তলায় আসন নিয়েছে। একদল উপর তলায় আর একদল নীচ তলায়। নীচ তলার লোকেরা উপর তলায় আরোহন করত পানি সংগ্রহের জন্য। ফলে দ্বিতীয় তলায় পানি পড়ত। তাই উপর তলার লোকেরা বলল তোমরা আমাদের এখানে পানি ফেলে আমাদের কষ্ঠ দিচ্ছ, সুতরাং আমরা তোমাদেরকে উপরে আরোহন করতে দিব না। নীচের তলার লোকেরা বলল, তবে আমরা জাহাজের তলা ফুটা করে পানির ব্যবস্থা করব। এ অবস্থায় উপরের তলার লোকেরা যদি নীচের তলার লোকদের হাত ঝাপটে ধরে ছিদ্র করা থেকে তাদেরকে বিরত রাখে তবে সকলেই বেঁচে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু যদি এদেরকে এ কাজে বাধা না দেয় তাহলে সকলেই ডুবে যাবে।
আমাদের সকলের উচিত খারাপ কাজ দেখলে বাধা দেওয়া। একটি জাতির উপর যখন আল্লাহর গযব আসলো তখন ফিরিশতারা আল্লাহর কাছে বললেন আল্লাহ! তাদের মধ্যে তো নেককার লোকও আছে। আল্লাহ তাআলা বললেন তাদেরকে সহ ধ্বংস করো, কেননা তারা তাদের দায়িত্ব আদায় করে নি। কারণ তাদের দায়িত্ব ছিল তারা খারাপ লোকদের বাধা দিবে।
বনী ইসরাইল জাতি ধ্বংসের কারণ হিসাবে আল্লাহ তাআলা বলেন
كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ.
তারা যে নিকৃষ্ট কাজ করত তা থেকে একে অপরকে বারণ করত না, তারা যা করত তা অবশ্যই খারাপ।
(আল-কুরআন, সূরা আল মায়িদা:৭৯)
ভুমিকম্প থেকে বাঁচার জন্যে আল্লাহর দরবারে তাওবাহ, ইসতিগফারের পাশাপাশি আমাদের জাগতিক সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা উচিত। এটা দূষণীয় নয়। আল্লাহর উপর ভরসা করব সাথে জাগতিক প্রস্তুতিও রাখব। হাদীস শরীফে আছে এক সাহাবী রাসূল (সা.)-এর দরবারে আসলেন। তিনি রাসূল (সা.) কে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার উট ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করবো না কি বেঁধে আল্লাহর উপর ভরসা করব? রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন أعقلها وتوكلউট বেধে আল্লাহর উপর ভরসা করো। সুতরাং আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করার সাথে সাথে জাগতিক সব ধরনের ব্যবস্থাও রাখব।
...........................
বর্তমান সময়ে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে মানুষ অনেক উচ্চকন্ঠ। কিছুদিন পূর্বেও পাশ্চাত্যে শ্রমিকদের সাথে অমানুষিক আচরণ করা হতো। আন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে। কিন্তু ইসলামের নবী মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) শ্রমকে শ্রদ্ধা করতে, শ্রমিককে তার ন্যায্য অধিকার দিতে স্পষ্ঠ নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ، قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করো।
ইসলামে কষ্টার্জিত উপার্জনকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। হাদীসে এসেছে-
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ
-কারো জন্যে নিজ হাতে উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করতেন।
ইসলাম ভিক্ষা করাকে নিরুৎসাহিত করেছে। নিজে কাজ করে খাওয়াকেই উৎসাহিত করেছে। নামায, রোযা সহ বিভিন্ন ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নিজের জন্যে, নিজের পরিবারের জন্যে হালাল রুযী অর্জন করাও ফরয। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
-তোমরা নামায শেষ করে যমীনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো।
হালাল উপার্জন করা আমাদের সকলের জন্যে আবশ্যক। উপার্জনের মাধ্যম আমাদের সকলের এক হয় না। এখানে আমরা কেউ মালিক আবার কেউ শ্রমিক। আমরা কেউ অফিসের কর্মকর্তা আবার কেউ আমাদের অধীনস্ত। কিন্তু সকলের উদ্দেশ্য এক। হালাল উপার্জন করা। আমাদের অধিনস্ত যারা আছে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি দেখানো উচিত। কেননা তারাও আমাদের ভাই। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
إخوانكم خُوَلُكم، جعلهم الله تحت أيديكم، فلا تُكَلِّفُوهم ما يغلبهم، فإن كَلَّفتموهم فأعينوهم
-তোমাদের অধিনস্তরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধিনস্ত করে দিয়েছেন। তাদের সাধ্যাতীত কাজ তাদের উপর চাপিয়ে দিও না। যদি চাপাতে চাও তাহলে তাদের সাহায্য করো।
এক সাহাবী তার গোলামকে নিয়ে বের হয়েছেন। পথিমধ্যে লোকজন চিনতে পারে নাই মুনিব কে আর গোলাম কে। তারা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন তোমরা কি রাসূল (সা.)-এর হাদীস শুনো নাই? রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরকেও তা পরাবে।
শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দয়া করা আমাদের কর্তব্য। এটা শ্রমিকদের হক। যে কাজ শ্রমিকের জন্য কষ্টকর সে কাজ তাদের দিয়ে করানো একপ্রকার অত্যাচার। তাদের প্রতি দয়া দেখাতে হবে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন الراحمون يرحمهم الرحمن দয়াশীলের প্রতি রহমান (আল্লাহ) দয়া করেন। তিনি আরো বলেন من لا يرحم لا يرحم যে দয়া করে না সে দয়া পায় না। শ্রমিককে তার যথাযথ মজুরী প্রদানে জোর তাকীদ এসেছে। আল্লাহ তাআলা নির্যাতিত শ্রমিকদের পক্ষে থাকেন। হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
ثلاثة أنا خَصمُهم يوم القيامة: رجل أَعطي بي ثم غدر، ورجل باع حرا فأكل ثمنه، ورجل استأجر أجيرا فاستوفى منه ولم يعط أجره
আল্লাহ তা‘আলা ফরমান, আমি কিয়ামতের দিন তিন শ্রেনীর মানুষের বিরুদ্ধে বাদী হবো। প্রথমত এমন লোক যে আমার নামে কাউকে অঙ্গীকার করলো অত;পর গাদ্দারী করলো, দ্বিতীয়ত এমন লোক যে স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করল এবং এর মূল্য খেলো, তৃতীয়ত এমন লোক যে কোন শ্রমিক নিয়োগ করলো আর সেই শ্রমিক যথাযথভাবে তার দায়িত্ব আদায় করলো, কিন্তু তার পারিশ্রমিক আদায় করেনি।
এই তিন শ্রেনীর লোকের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বাদী হবেন।
শ্রমিকদেরও অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। যখন কোন কাজ আদায় করবে তখন যথাযথভাবে আদায় করবে, কাজকে নিজের মনে করে সুন্দরভাবে করবে। হাদীস শরীফে এসেছে-
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يُحِبُّ مِنَ الْعَامِلِ إِذَا عَمِلَ أَنْ يُّحْسِن
সুন্দরভাবে কাজ সম্পাদনকারী শ্রমিককে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন।
শ্রমিকরা নিজেদেরকে নির্যাতিত মনে করলে তারা নিয়মের মধ্যে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে এর প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু রাগ-বিরাগ বা আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের কল-কারখানা, অফিসের ক্ষতি সাধন উচিত নয়।কেননা এটাই তার রিযিক পাওয়ার মাধ্যম। হাদীসে এসছে من رزق في شيئ فليلزمهযাকে কোন মাধ্যমে রিযিক দেওয়া হলো, উচিত হলো সে তা আঁকড়ে থাকবে। অর্থ্যাৎ নিজের উপার্জনের মাধ্যমকে আল্লাহর নি‘আমত মনে করে তার মূল্যায়ন করতে হবে।
আজকে আমরা দুটি বিষয়ে আলাচনা করলাম। প্রথমত বিপদাপদ প্রসঙ্গ। আমরা জানতে পারলাম বিপ; আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। কখনো মানুষের গোনাহের কারণে আবার কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য।
দ্বিতীয়ত আমাদের অধীনস্ত মানুষদের প্রতি সদাচরণ করা ইসলামের নির্দেশ। বিশেষত শ্রমজীবি মানুষের প্রতি আমাদের সদাচরনের জন্য প্রিয়নবী (সা.) জোর তাকীদ প্রদান করেছেন। আল্লাহ উত্তম তৌফিক দাতা।
১.০৫.১৫
[অনুলিখন : মাওলানা মাহমুদুল হাসান]

সোমবার, ৪ মে, ২০১৫

রজব মাস হলো রামাদ্বান মাসের প্রস্তুতির মাস


মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী
الحمد لله المتقدس بنعوت الكمال، المتعالي علي عباده بصفات الجلال، الي عباده بصفات الجمال، نحمده حمد الشاكرين لفضله، المقرين بألوهيته ووحدانيته، ونصلي ونسلم علي سيدنا محمد، السابق إلي الأنام نورُه، والرحمة للعالمين ظهورُه، صلوةً تستغرق العد، وتحيط بالحد، لا أمد لها، ولا انقضاء لها، ولا انفصام لها، ولا انقطاع لها، وعلي اله الأطهار وصحبه الأبرار. أما بعد-
আলহামদুলিল্লাহ! আমরা রজব মাসের প্রথম জুমু‘আয় উপস্থিত হতে পেরেছি। মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি। রজব মাস মুসলমানদের কাছে বিশেষ একটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি এই মাসে মহান আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরশে আযীমে নিয়ে মি’রাজ করিয়েছেন। ইসরাকে (মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত) অস্বীকার করা কুফরী। মহান আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে ফরমান-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ.
-পবিত্রতা ও মহিমা সেই মহান সত্ত্বার যিনি তার বান্দাহকে রাতে ভ্রমন করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত-- যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি-- তাঁকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু শুনেন এবং সব কিছু দেখেন।
রজব মাস রাসূল (সা.)-এর মি‘রাজের মাস। এই মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়। হাদীস শরীফে এসেছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বলেন-
وَإِنَّمَا سُمِّيَ رَجَبٌ ، لأَنَّ الْمَلائِكَة تَرْجُبُ فِيهِ بِالتَّسْبِيحِ وَالتَّحْمِيدِ وَالتَّمْجِيدِ لِلْجَبَّارِ عَزَّ وَجَلَّ.
-রজব মাসকে রজব বলার কারণ হলো এই মাসে ফিরিশতারা বেশি বেশি মহান আল্লাহর তাসবীহ, তাহলীল এবং তাহমীদ করেন। আমাদেরকেও এর সাথে বেশি বেশি তাসবীহ পড়া উচিৎ। বুখারী শরীফের শেষ হাদীস, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
كَلِمَتَانِ حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَنِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ ثَقِيلَتَانِ فِي الْمِيزَانِ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ.
-দু’টি শব্দ মহান আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়, যা উচ্চারণে অতি হালকা কিন্তু মিযানের পাল্লায় খুবই ভারি, শব্দ দু’টি হলো- سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ
রজব মাস সম্পর্কে আবুল ওয়াররাক বলখী (র.) বলেন-
شهر رجب شهر الزرع وشعبان شهر السَّقِي للزرع، وشهر رمضان شهر حصاد الزرع.
-রজব হলো চারা রূপনের মাস, শা‘বান হলো পানি সিঞ্চনের মাস আর রামাদান হলো ফল আহরণের মাস।
সুতরাং রজব মাস থেকে আমাদেরকে রামাদানের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।
হাদীস শরীফে আরো এসেছে-
كان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا دخل رجب قال : اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان
-রজব মাস আসলে রাসূল (সা.) দু‘আ করতেন-হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে রজব এবং শা‘বান মাসের বরকত দান করো আর রামাদান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।
হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ نَهْرًا ، يُقَالُ لَهُ : رَجَبٌ ، مَنْ صَامَ مِنْ رَجَبٍ يَوْمًا وَاحِدًا ، سَقَاهُ اللَّهُ مِنْ ذَلِكَ النَّهْرِ.
-জান্নাতে একটি ঝর্ণা আছে যার নাম রজব। যে ব্যক্তি রজবে একটি রোযা রাখবে মহান আল্লাহ তাকে এই ঝর্ণার পানি পান করাবেন।
মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে রজবের আমল করার তাওফীক দান করেন। আমীন।
.................
ভারত উপমহাদেশ এবং আমাদের দেশের মুসলমানদের কাছে রজব মাস আরো দু‘টি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো এই মাসের ৬ তারিখ অর্থাৎ ৬ রজব সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরীবে নেওয়ায শাহ মুঈনুদ্দীন চিশতী সনজরী আজমিরী (র.)-এর ওফাত দিবস। আর ২০ রজব হযরত খাজা শরফুদ্দীন চিশতী (র.)-এর ওফাত দিবস।
ভারত উপমহাদেশে ইসলাম আগমন সম্পর্কে সকল ঐতিহাসিক একমত যে এ উপমহাদেশে আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার হয়েছে। সুফিয়ায়ে কেরাম ইসলামের পতাকা উড়িয়েছেন। সে জন্যে উপমহাদেশে ও আমাদের দেশের মুসলমানগণ তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (র.) সহ অন্যান্য আউলিয়ায়ে কেরাম এ দেশে তরবারীর জোরে ইসলাম প্রচার করেন নি। তাঁরা তাদের আদর্শ, মহত্ত্ব দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন।
খাজা আজমীরী (র.) যখন ভারতে আসেন তখন আজমীরের শাসক ছিল পৃথ্বিরাজ। সে ছিল খুবই অত্যাচারী শাসক ছিল। রাজা পৃথ্বিরাজ কোন এক মুসলমানকে ( সম্ভবত তাঁরই দরবারের সাথে সম্পর্কিত কেউ হবেন)- কষ্ট ও বিপদের মধ্যে ফেলেন। এর প্রতিকার চেয়ে হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতী (র) পৃথ্বিরাজকে একটি পত্র লিখেন। পৃথ্বিরাজ অত্যন্ত গর্বভরে অবমাননাকর ভাষায় ঐ পত্রের জবাবে বলেন- ‘এই লোকটি এখানে আসার পর এমন বড় বড় কথা বলে যা কেউ কখনও বলেনি এবং শুনেও নি।’ হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতী (র) ঐ জবাব শুনে বললেন, ‘ আমি পৃথ্বিরাজকে জীবিত বন্দী করে মুহাম্মাদ ঘুরীর হাতে তুলে দিলাম’। সেই রাতে মুহাম্মদ ঘুরী স্বপ্নে দেখেন কোন এক বুযুর্গ তাকে বলছেন- কাল যদি তুমি ভারত আক্রমন করো তাহলে তুমি ভারত জয় করতে পারবে। মুহাম্মদ ঘুরী ইতিপূর্বে ভারত আক্রমন করে ব্যর্থ হয়েছেন। এ স্বপ্ন দেখার পর সভাসদদের সাথে আলোচনা করে ভারত আক্রমন করেন। মুহাম্মদ ঘুরী ভারত জয় করেন এবং পৃথ্বিরাজকে বন্দী করেন। মহান আল্লাহ তার ওলীর কথাকে সত্যে পরিণত করলেন। ঘটনাটি আবুল হাসান আলী আন-নদভী তার “দা‘ওয়াত ও আযীমত” কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.) “আখবারুল আখয়ার” কিতাবে লিখেন- হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (র.)-এর ইন্তিকালের পর তার কপালের উপর লেখা ফুটে উঠে- حبيب الله مات في حب الله “আল্লাহর বন্ধু, আল্লাহর ভালোবাসায় ইন্তিকাল করেছেন”। জানা যায় তার কপালে এই লেখা দেখে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে।
খাজা ছাহেব (র.)-এর সময়ে ভারতে যাদুবিদ্যার প্রচলন খুব বেশি ছিল। যে যুগে যে সব বিষয়ের বেশি প্রচলন ছিল আল্লাহ তাআলা সে যুগের নবীকে উক্ত বিষয়ের মু‘জিযা দান করেছেন। হযরত মুসা (আ.)-এর সময়ে যাদুর চর্চা ছিল। এই সকল যাদুকরের যাদুকে অক্ষম করতে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) কে লাঠি ও শুভ্র হাত দিয়েছেন। ঈসা (আ.)-এর যুগে চিকিৎসা বিষয়ে মানুষ পারদর্শী ছিল। তাই তাঁকে আল্লাহ তা’আলা জন্মান্ধ ও ধবল রোগীকে সুস্থ করার মু’জিযা প্রদান করেন। আমাদের নবী (সা.)-এর সময়ে কবিতা চর্চার প্রচলন ছিল ব্যপক। তৎকালীন প্রসিদ্ধ কবিগণ বিভিন্ন মেলায় কবিতার আসর করত, চর্চা করত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন নাযিল করে এই সব কবিদের কাব্যপ্রতিভাকে অক্ষম করে দিলেন। মহান আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করলেন এর ছোট একটি আয়াতের সমান আয়াত রচনা করতে। কিন্তু তারা তা পারে নি।
আল্লাহ তাআলা নবীদেরকে অলৌকিক যে ক্ষমতা দান করেন তাকে মু‘জিযা বলে আর ওলীগণকে যে ক্ষমতা দান করেন তাকে কারামত বলে। কারামত সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদা কি, সে সম্পর্কে আকাইদে নাসাফীতে বলা হয়েছে- كرامة الأولياء حق-আউলিয়ায়ে কেরামের কারামত সত্য।
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (র.) সব সময় ওযূর সহিত থাকতেন, সারাজীবন দিনে রোযা রাখতেন রাতের বেলা ইবাদত করতেন। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দু’বার কুরআন শরীফ খতম করতেন।
আগে একবার বলেছি যে ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন আউলিয়ায়ে কিরাম। তাঁরা তাদের আদর্শ দিয়ে মানুষকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রা.) (র.) ছিলেন সিজিস্তানের মানুষ। তিনি স্থানীয় ভাষা বুঝতে পারতেন না। হযরত শাহজালাল মুর্জারাদে ইয়ামনী (র.) ছিলেন ইয়ামনের অধিবাসী, আরবী ভাষাভাষী। তিনি বাংলা বুঝতেন না। এখানে যারা বাসিন্দা ছিলেন তারাও আরবী বুঝতেন না। তাহলে তারা কিভাবে ইসলাম প্রচার করলেন? তাদের কথা মানুষ কিভাবে বুঝতো অথবা তারা কিভাবে মানুষের কথা বুঝতেন? মানুষ তাদের চেহারা দেখে, তাদের আদর্শ দেখে মুসলমান হয়েছে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন إذا رؤوا ذكر الله -ওলী হচ্ছেন তিনি যাকে দেখলে মহান আল্লাহকে স্মরণ হয়।
আমরা এই সব মহান বুযুর্গদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের উচিত তাদের জন্য দু‘আ করা। তাদের জন্যে দু‘আ করলে আমরাই উপকৃত হবো। আমরা তাদের রূহানী ফায়য লাভ করতে পারব। দু’রাকাআত নামায পড়ে অথবা কুরআন তিলাওয়াত করে, সাদকাহ করে অথবা অন্য নেক আমল করে তাদের রূহের উদ্দেশ্যে ঈসালে সাওয়াব করতে পারি। রূহ মারা যায় না। মুসলমান হোক অথবা বিধর্মী হোক, কারো রূহ মারা যায় না। কুরআন শরীফে ইরশাদ হচ্ছে وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছি।
হযরত আজমীরী (র.) সম্পর্কে আমাদের পীর ও মুরশিদ হযরত আল্লামা আব্দুল লতীফ ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর একটি ঘটনা মনে পড়ল। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা (র.) বলেন আমি ছাত্র জীবনে আযমিরী (র.)-এর মাযারে খুব বেশি আসা-যাওয়া করতাম। একদিন আযমিরী (র.) আমাকে বলছেন- এখানে বেশি আসার প্রয়োজন নেই। বদরপুরেই থাকো। ওখান থেকেই তুমি সবকিছু হাসিল করতে পারবে। ছাহেব কিবলাহ (র.) স্বপ্নে না মুরাকাবায় সাক্ষাৎ করেছেন তা আমাদের বলেন নি। সুবহানাল্লাহ। এটাই হচ্ছে ওলীদের ক্ষমতা। ইন্তেকালের পরেও তারা সঠিক পথ দেখাতে পারেন।
আউলিয়ায়ে কেরামের দরগাহ গরীব-অসহায়দের আবাসস্থল। আমাদের সামনে যিনি শুয়ে আাছেন খাজা শরফুদ্দীন (র.), তার দরগাহতে প্রতিদিন কয়েকশ’ গরীব-অসহায়কে খাদ্য বিতরণ করা হয়। আমাদের কারো বাড়িতে কি সম্ভব প্রতিদিন দুইশত মানুষকে খাবার প্রদান করা? সম্ভব নয়। ওলীগণের ইীন্তকালের পরেও মানুষ তাদের কাছ থেকে উপকৃত হয়।
আমরা আউলিয়ায়ে কেরামের মাযারে যাই। সুন্নত নিয়মানুযায়ী মাযার যিয়ারত করি। তাদের ওসীলা নিয়ে আল্লাহর দরবারে দু‘আ করি। উমাইয়া (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম গরীব মুহাজিরদের ওসীলায় বিজয়ের দু‘আ করতেন। (শরহুস সুন্নাহ)
আমরা ওলীর কাছে চাই না বরং তার ওসীলা নিয়ে আল্লাহর দরবারে দুআ করি। এখন কিছু ভ-ের কারণে তো আমরা হক্কানী ওলীদের থেকে দূরে থাকতে পারি না। আসলের সাথে নকল সব সময় ছিল, থাকবে। তাফসীরের ক্ষেত্রেও ভেজাল করা হয়েছে। শি‘আ, মু‘তাযিলা, খারেজীরা তাদের ইচ্ছামতো কুরআন শরীফের তাফসীর করেছে, তাফসীর বির রায় করা হয়েছে। তাই বলে কি আমরা সঠিক তাফসীরগুলো ছেড়ে দিব? রাসূল (সা.)-এর ওফাতের কিছুকাল পরেই হাদীসের ক্ষেত্রে জাল হাদীস রচনা শুরু হয়। স্বার্থান্বেষী মানুষ নিজ স্বার্থে হাদীস বানাতো। এক মুসলিম বাদশাহকে এক বেগুন বিক্রেতা তার বেগুনের গুনাবলী বর্ণনা করার জন্যে বানিয়ে বললো রাসূল (সা.) ইরশাদ বরেছেন- বেগুন সকল রোগের ঔষধ। রাসূল (সা.)-এর হাদীস শুনে খলীফা বেগুন নিলেন। খাওয়ার পর তার চুলকানী রোগ হয়ে গেল। বাদশাহ বিক্রেতাকে ধরিয়ে এনে বললেন তুমি বললে সকল রোগের ঔষধ কিন্তু আমার তো চুলকানী হয়ে গেছে। তখন সে বলল ওহ! আমি ভূলে গিয়েছিলাম। হাদীসে ছিল চুলকানী রোগ ছাড়া সকল রোগের ঔষধ।
এভাবে নিজ স্বার্থে কিছু লোক হাদীস বানিয়ে রাসূল (সা.)-এর নামে চালিয়ে দিত। জাল হাদীসের ছড়াছড়ি শুরু হলো। তাই বলে কি আমরা মূল হাদীস ছেড়ে দিব? যে কোন ভালো ভালো পন্য বাজারে আসলে তার নকলও বের হয়। সে জন্যে তো আমরা আসলকে ছেড়ে দেই না। তদ্রুপ তাসাউফের নামে ভ-ামী করলে আমরা ভ-ামী থেকে দূরে থাকবো কিন্তু হাক্কানী ওলী আউলিয়াকে ত্যাগ করতে পারি না। তাদের আদর্শ অনুসরণ করব। কারণ যাকে মুহাব্বাত করা হয় তার সব কিছু অনুসরণ করতে হয়। এক কবি বলেন- إن المحب لمن يحب مطيع
আউলিয়ায়ে কিরামের আদর্শ ছিল মানুষকে তাওহীদ-রিসালতের পথে আহ্বান করা, অসহায় দুঃস্থ মানুষের সেবা করা, দ্বীনের খেদমত করা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً
আউলিয়ায়ে কেরাম আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন ছিলেন।
মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে আউলিয়ায়ে কিরামের অনুসরণের তাওফীক দান করেন। আমীন।
..................
এখন নামায সম্পর্কে দু’টি কথা বলতে চাই। আমরা যখন একাকী নামায পড়ি তখন সূরা আসর এবং কাউসার পড়ে দায় সারি। কিন্তু ইমামতির সময় লম্বা সূরা পাঠ করে মানুষের বিরক্তি বাধিঁয়ে দেই।
জামা‘আতের সহিত নামায আদায় করলে আমাদের নামায কেমন হওয়া উচিৎ প্রিয়নবী (সা.) থেকে এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা পাই।। একবার হযরত মু‘য়ায বিন জাবাল (রা.) নামাযের ইমামতি করছেন। তিনি নামাযে সূরা বাকারাহ তিলাওয়াত শুরু করলেন। একজন নামায ছেড়ে দিয়ে একাকী সংক্ষিপ্তভাবে নামায পড়লেন। তখন তাকে মু‘আয (রা.) মুনাফিক বলে ধারনা করলেন। লোকটির কাছে এ সংবাদ পৌছলে তিনি রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা হাত দিয়ে খেটে খাওয়া এবং উট দিয়ে পানি সিঞ্চনকারী লোক। মু‘আয নামাযে সূরা বাকারাহ তিলাওয়াত শুরু করছেন। তাই আমি একা নামায সংক্ষেপে আদায় করে চলে গেছি। ফলে তিনি আমাকে মুনাফিক ধারণা করেছেন। রাসূল (সা.) তিনবার বললেন হে মু‘আয! তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি করছ? (জামা‘আতে নামায আদায় করলে) সূরা শামস এবং আ‘লা দিয়ে পড়বে। আরেক বর্ণনায় আছে, সূরা শামস এবং আ‘লা দিয়ে পড়বে কেননা তোমাদের পিছনে বৃদ্ধ, দূর্বল এবং হাজতওয়ালা লোক নামায আদায় করে।
তাই আমরা যখন জামা‘আতে নামায পড়ব সংক্ষিপ্ত নামায পড়ব। একাকী হলে যত ইচ্ছা লম্বা নামায পড়ব। হাদীসে এসেছে-
وعن أبي هريرة - رضي الله عنه : أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قال: إذا صلى أحدكم للناس فليخفف؛ فإنه منهم الضعيف، والسقيم، والكبير، وإذا صلى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء.
-হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: তোমরা যখন মানুষকে নিয়ে (জামা‘আতে) নামায আদায় করো তখন সংক্ষিপ্তভাবে পড়। কেননা তাদের মধ্যে দূর্বল, অসুস্থ এবং বৃদ্ধ লোক থাকে। আর যখন একাকী নামায পড় তখন যতক্ষন ইচ্ছা লম্বা করো।
(সুপ্রিম কোর্ট মাজার মসজিদে জুমআপূর্ব বয়ান, ৪-০৫-২০১৫
অনুলিখন : মাহমুদুল হাসান)

বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৫

ন্যায়পরায়নতা ও ইহসান : ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি


মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী

মহান আল্লাহ মানব জাতির হেদায়তের জন্যে রাসূল (সা.)-এর কাছে পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল করেন। এই কুরআন এমন একটি বিস্ময়কর গ্রন্থ যার তুলনার সমকক্ষ কোন গ্রন্থ নেই, অমুসলিমরাও এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। আরবে কবিতা চর্চার রীতি ছিল। উকায মেলায় পৃথিবী বিখ্যাত কবিরা আসতেন, তাদের কবিতা পাঠ করতেন। যাদের কবিতা নির্বাচিত হতো তাদের কবিতা কা‘বা শরীফে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সূরা কাউসার অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূল (সা.) সেটা লিখে কা‘বা শরীফে ঝুলিয়ে দেন এবং ঘোষণা দেন যে, এই সূরার পরের লাইন মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। রাসূল (সা.)-এর সময়ে আরবের প্রসিদ্ধ ও বয়োবৃদ্ধ কবি ছিলেন লবীদ ইবনু রবী‘আহ। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সূরা কাউসারের শেষে লিখেন ليس هذا كلام البشر অর্থ্যাৎ- এটা কোন মানুষের কথা নয়।সুতরাং বুঝা গেল সে এটা স্বীকার করছে যে কুরআন আসমানী গ্রন্থ।
আল্লাহ তা‘আলা সেই কুরআনে ইরশাদ করেন-
{ إِنَّ اللَّه يَأْمُر بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَان وَإِيتَاء ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنْ الْفَحْشَاء وَالْمُنْكَر وَالْبَغْي يَعِظكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
-নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ন্যায়পরায়নতা, ইহসান, ও আত্মীয়তা রক্ষার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং যাবতীয় অশ্লীল, গর্হীত কাজ ও বিদ্রোহ করা থেকে নিষেধ করছেন।
আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সা.) ওয়ালীদ ইবনু মুগীরাহকে শুনালেন। ওয়ালীদ এই আয়াত শুনে বলল- إن له لحلاوة وإن عليه لطلاوة
এই আয়াতে কতো মিষ্ঠতা এবং এই আয়াত সব কিছুর নির্যাস।(শুআবুল ঈমান)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন-
إن أجمع آيةٍ في القرآن ِلـخيرٍ وشرٍّ هذه الآية
ভালো এবং মন্দ কাজের বিবরণ প্রদানে পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত সমূহের মধ্যে সর্বাধিক অর্থবহ আয়াত হলো এই আয়াত।
আদল বা ন্যায়পরায়নতা সর্ব ক্ষেত্রে রক্ষা করতে হবে। বিচারকার্য, ইবাদত, পারিবারিক জীবনসহ সকল ক্ষেত্রে আদল রক্ষা করতে হবে।
প্রিয়নবী (সা.)-এর জীবনে আমরা ন্যায়পরায়নতার উজ্জল দৃষ্ঠান্ত খুঁজে পাই। কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত মহিলার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আসল। অপরাধ প্রমাণিত হলে রাসূল (সা.) হাত কাটার নির্দেশ দিলেন। কোন কোন মহিলা হযরত আয়শা (রা.)-এর কাছে গেলেন এবং রাসূল (সা.)-এর কাছে অপরাধ মার্জনার সুপারিশ করতে বললেন। তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বললেন উসামা বিন যায়দকে প্রেরণ কর। কারণ রাসূল (সা.) তাকে ও তাঁর বাবাকে খুব ¯েœহ করেন। উসামা (রা.) সুপারিশ করলে রাসূল (সা.) দৃঢ় কন্ঠে বললেন وأيمُ اللَّهِ ! لَو أنَّ فاطمةَ بنتَ محمَّدٍ سرَقَت لقطعتُ يدَها.
আল্লাহর কসম! যদি আমার মেয়ে ফাতিমাও চুরি করতো তাহলে আমি তাঁর হাত কেটে দিতাম। (সুবহানাল্লাহ)
এটাই হচ্ছে ন্যায়পরায়নতা, ইনসাফ। ইনসাফ রক্ষায় কোন স্বজনপ্রীতি নেই। আপন-পর সবাই সমান।
আরেকটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা.) এর খেলাফতকালে তার একটি যুদ্ধবর্ম হারিয়ে যায়। কিছুদিন পর তিনি সে বর্ম এক খৃস্টানের কাছে দেখতে পেলেন। আলী (রা.) এ বিষয়ে তার নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক শুরাই্হ (রা.)-এর কাছে বিচারপ্রার্থী হলেন। বিচারক শুরাইহ খৃস্টানকে বললেন আলী (রা.) যা বলছেন তা কি ঠিক? সে বলল বর্মটি আমার হাতে আর আমীরুল মুমিনীনকে আমি মিথ্যাবাদি বলতে পারিনা। তখন বিচারক শুরাইহ আলী (রা.) কে বললেন আপনার কথার পক্ষে কোন প্রমাণ আছে? তিনি বললেন না, আমার কাছে কোন প্রমান নেই। ইসলামী উসূল অনুযায়ী বিচারক খৃস্টানের পক্ষে রায় দিলেন। খৃস্টান লোকটি কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর ফিরে এস বলল এটাই হচ্ছে নবীদের ফয়সালা। এই বর্মটির মালিক আলী (রা.)। অতপর লোকটি কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল।
এটা হচ্ছে সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ। তাদের আদর্শ দেখে অমুসলিমগণ ইসলামের ছায়াতলে এসেছে। আলী (রা.) যদি জোর করে বর্মটি নিয়ে নিতেন তাহলে সে হয়ত মুসলমান হতো না।
এখানে লক্ষনীয়, হযরত আলী (রা.) নিজে খলীফা আর শুরাইহ তার নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক। শুরাইহ ন্যায়বিচার করেছেন। আলী (রা.) তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে পারেন নি। তাই ইনসাফ অনুযায়ী খলীফার পক্ষে রায় না দিয়ে খৃস্টানের পক্ষে রায় দেন। আলী (রা.)ও রায় মেনে নেন। এটাই ইসলামের ন্যায়পরায়নতা। বিচারের ক্ষেত্রে কোন স্বজনপ্রীতি নেই।
আমরা ইবাদতের ক্ষেত্রেও আদল ঠিক রাখবো। কোন প্রকার সীমা লঙ্ঘন করবো না। তিনজন সাহাবী আম্মাজান আয়শা (রা.)-এর কাছে রাসূল (সা.)-এর ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারপর তাদের একজন বললেন-আমি আর কোন রাত্রে ঘুমাব না, সারা রাত ইবাদত করব। অপরজন বললেন আমি এখনো বিয়ে করিনি, আর কোন দিন বিয়ে করব না বরং ইবাদত করব। আরেকজন বললেন আমি সারা জীবন রোযা রাখব।
রাসূল (সা.) শুনে অত্যন্ত রাগ করলন এবং বললেন- আমি নবী; রাত্রে ইবাদতও করি আবার নিদ্রা যাপনও করি, আমি বিবাহ-শাদীও করেছি, আমি রোযা রাখি আবার মাঝে মাঝে রোযা ছাড়ি।
এই হাদীসে রাসূল (সা.) এটাই বুঝালেন ইবাদতের ক্ষেত্রেও ন্যায়পরায়নতা রক্ষা করতে হবে। রাসূল (সা.) যে তরীকা প্রদর্শন করেছেন সে তরীকাতেই ইবাদত করতে হবে।
আপনি আপনার সন্তানাদির ক্ষেত্রেও ইনসাফ করতে হবে। একাধিক সন্তান থাকলে মীরাছের ক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখতে হবে।
আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার ঘৃণ্যতাকে গ্রহণ করেছি। অথচ এই সভ্যতা আমাদের কিছুই দিতে পারে নি। গত কয়েক মাস আগে আমেরিকায় একজন কৃষাঙ্গ হত্যা করা হয়েছে শুধুমাত্র কালো হওয়ার অপরাধে। আমাদের নবী (সা.) চৌদ্দশত বছর আগে বলে গেছেন-
لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى أَعْجَمِيٍّ ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ ، وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى
আরবী-অনারবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, শ্বেতাঙ্গ-কৃষাঙ্গের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
হযরত বিলাল (রা.) হাবশী, কালো দাস ছিলেন। তিনি মুসলমান হওয়ার কারণে তপ্ত বালুকাময় মাঠে তার বুকে পাথর রেখে নির্যাতন করা হতো। আবূ বকর (রা.) তাকে ক্রয় করলেন এবং আযাদ করে দিলেন। রাসূল (সা.) হাবশী বিলালকে ্ইসলামের প্রথম মুআয্যিন নির্বাচন করলেন। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা.) তাকে কা‘বার পিঠে তুলে আযান দিতে বললেন। ইসলামে সাদা-কালোর কোন পার্থক্য নেই। ইসলামে সবাই এক।
আয়াতের দ্বিতীয় নির্দেশ হলো-ইহসান। আরবী ইহসান শব্দটি হুসনুন থেকে এসেছে। হুসন অর্থ সৌন্দর্য। আমাদের জীবনের সকল কিছু সুন্দরভাবে করতে হবে। আমাদের প্রত্যেককে একজন মুসলিম হওয়ার পাশাপাশি একজন মুহসিন হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- وأحسنوا إن الله يحب المحسنين
এক্ষেত্রে আমাদের অনুপম আদর্শ হচ্ছেন মুহসিনে আ‘যম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আমাদের নামায, আমাদের আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র সুন্দর্যমন্ডিত হওয়া উচিত। নামায সুন্দর হওয়ার ব্যাপরে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
الإحسانُ أن تعبد الله كأنك تراه فإن لم تكن تراه فإنه يراك
-তুমি এমনভাবে নামায পড় যেন আল্লাহ তা‘আলাকে দেখছ আর যদি দেখতে না পার তাহলে ধারণা রাখো আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। আমাদের নামায যতো সুন্দর হবে আমাদের জীবন ততো উজ্জল হবে।
ইহসান বা দয়া দিয়ে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। প্রসিদ্ধ ঘটনা, এক জান্নাতী রমনীকে বিড়ালের সাথে দুর্ব্যবহার করার কারণে জাহান্নামে যেতে হয়েছে। আর এক ব্যভিচারিনী মহিলা কুকুরের প্রতি দয়া করে ঈমানদার হয়ে বেহেশতী হয়েছে।
আমরা রাসূল (সা.) এর জীবনে ইহসান বা দয়ার বিরল দৃষ্টান্ত পাই। হযরত যায়দ (রা.) দাস ছিলেন। উকায মেলায় ক্রয় করে আম্মাজান খাদিজা (রা.) কে তাঁর খালু উপহার দিয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে পেশ করেন। রাসূল (সা.) তাকে তাঁর পুত্রের মর্যাদা দান করেন। তখনও এই আয়াতটি নাযিল হয়নি-
مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
অনেক দিন পর তার স্বজনরা তার খোঁজ পেয়ে তার বাবা-চাচা রাসূল (সা.)-এর কাছে আসলেন। এসে বললেন আপনি যা চান আমরা দিতে রাজি আছি, বিনিময়ে আপনি আমাদের ছেলেকে দিয়ে দিন। রাসূল (সা.) তাদেরকে বললেন
ادعوه فخيراه فإن اختاركما فهو لكما بغير فداء وإن اختارني فو الله ما أنا بالذي أختار على من اختارني وقال زيد: والله يا رسول الله أنت مني بمنزلة الأب والعم وما أختار عليك أحداً قط)) فقال له والده: أتختار العبودية على الحرية وعلى أبيك وعمك يا زيد؟
তাকে ডাকেন এবং তার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিন। সে যদি আপনাদের সাথে যেতে চায় তাহলে কোন বিনিময় লাগবে না আমি তাকে দিয়ে দিব। আর যদি সে আমার কাছে থাকতে চায় তাহলে আল্লাহর কসম! যে আমার কাছে থাকতে চায় আমি তাকে রাখব। (যায়দ রা. কে জিজ্ঞেস করার পর) তিনি বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি-ই আমার বাবা, আপনি-ই আমার চাচা।
অতপর যায়দ (রা.)-এর বাবা বললেন- যায়দ! তুমি তোমার বাবা-চাচাকে ছেড়ে স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধিনতাকে গ্রহণ করলে?
রাসূল (সা.) শুধু মানুষকে দয়া করেন নি; জীন-ইনসান, পশু-পাখি, বৃক্ষ-লতাসহ সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ছিল অবারিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- তোমরা যখন পশু কুরবানী করো তখনও উত্তমভাবে যবেহ করো, যে ব্যক্তি পশু কুরবানী করবে সে যেন তার ছুরি উত্তমভাবে ধারালো করে নেয়।
হযরত আবূ বকর (রা.) একদিন তার এক খাদিমকে একটু ধমক দিচ্ছিলেন, রাসূল (সা.) শুনে বললেন- খাদিমদের প্রতি এরূপ আচরণ আর সিদ্দীক এক সঙ্গে হতে পারে না।
সুতরাং আমরা মানুষের প্রতি দয়া করব, আল্লাহর সৃষ্ঠ জীবদের প্রতি দয়া করব। প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন- তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া করো, আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন। মহান আল্লাহ যেন আমাদের তাওফীক দান করেন। আমীন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- كونوا مع الصادقينতোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।
সে জন্যে আমরা আউলিয়ায়ে কেরামের দরবারে আসি। তাঁদের দরবারে আসলে, তাদের সঙ্গী হলে আমরা আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারি। ওলী কারা? রাসূল (সা.) ওলীদের পরিচয় দানে বলেন- যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয় তাঁরাই ওলী।
সোহবত বা সংস্পর্শের অনেক প্রভাব রয়েছে। একটি উদাহরণ দেই, আমরা যখন শিশুদের সাথে কথা বলি তখন আমাদের মধ্যে শিশু সুলভ আচরণ চলে আসে। আমরাও শিশুর সুরে ও স্বরে কথা বলি যা স্বাভাবিক কথা-বার্তায় চিন্তাও করতে পারি না। তখন আমরা একপ্রকার শিশু হয়ে যাই। তদ্রুপ ওলী আল্লাহদের কাছে আসলে আমাদের মন-মানসিকতা আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। তাদের আচরণ ও আমল দ্বারা আমরাও প্রভাবিত হই।
ইমাম শাফেঈ (র.) কোন সমস্যায় পড়লে ইমামে আযম আবূ হানীফা (র.)-এর মাযারে চলে যেতেন। সেখানে নামায পড়তেন, যিয়ারত করতেন। ইমাম শাফেঈ নামাযে রাফউল ইয়াদাইন এর পক্ষে। কিন্তু তিনি ইমাম আযমের কবরে গিয়ে নামাযে রাফউল ইয়াদাইন করতেন না। ইমাম আবূ হানীফার সম্মানের জন্য। সুতরাং আমরা ওলী আল্লাহদের সম্মানের প্রমাণ পাই ইমাম শাফেঈ (র.)-্এর আমল থেকে।
আর পবিত্র শুক্রবার দিনের কিছু আমল রয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে- যে ব্যক্তি শুক্রবার সূরা কাহ্ফ তিলাওয়াত করবে, পরবর্তী শুক্রবার পর্যন্ত তাকে নূর দান করা হবে। অনেকে জানতে চান সূরাটি কখন পড়া হবে। জুম‘আর পূর্বে পড়ে নেয়া ভাল। যদি না পারেন আসরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় পড়ে নিতে পারেন।
আরেকটি হলো বেশি বেশি দুরূদ শরীফ পড়া। হাদীস শরীফে আছে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- তোমরা শুক্রবার বেশি বেশি দুরূদ পড় কেননা তোমাদের দুরূদ আমার নিকট পৌছানো হয়। সাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যখন কবরস্থ হবেন তখনও? রাসূল (সা.) জবাব দিলেন إن الله حرم على الأرض أن تأكل أجساد الأنبياء আল্লাহ তা‘আলা নবীগণের দেহ ভক্ষণ করা মাটির জন্যে হারাম করে দিয়েছেন।
রাসূল (সা.)-এর এই হাদীস বাতিল আকীদাকে খন্ডন করে। যারা হায়াতুন্নবীকে অস্বীকার করেন তাদের ভ্রান্ত আকীদা এই হাদীস দ্বারা খন্ডন করা হয়েছে। রাসূল (সা.) তাঁর কবরে স্বশরীরে জীবিত আছেন, এই কথা কাফেররাও স্বীকার করে। সে জন্যে তারা তাঁর লাশ মুবারক চুরির ষড়যন্ত্র করেছিল।
দুরূদ শরীফ যে পড়ে তার নাম, পিতৃপরিচয়সহ রাসূল (সা.)-এর দরবার হাজির করা হয়। ’দালাইলুল খায়রাত’, এবং ইবনুল জাওযীর ‘আল ওয়াফা’ কিতাবে আছে মুহব্বতের সহিত যে দুরূদ শরীফ পড়ে রাসূল (সা.) নিজ কান মুবারক দ্বারা তার দুরূদ শুনতে পান।
অনুলিখন- মাহমুদুল হাসান।

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টিতে যঈফ হাদীসের উপর আমল করা জায়িয ও মুস্তাহাব

[মুফতী মাওলানা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী’র ‘তাকলীদ-এর সুদৃঢ় রজ্জু’ থেকে]
গায়র মুকল্লিদগণ হাফিয ইবনে তাইমিয়ার অনুসরণ করেন বলে দাবি করেন অথচ ইবনে তাইমিয়া মৃতের তালকীন সম্পর্কে বলেন-
وروى في تلقين الميت بعد الدفن حديث فيه نظر، لكن عمل به رجال من أهل الشام الأولين، مع روايتهم له، فلذلك استحبه أكثر أصحابنا وغيرهم. (إقتضاء الصراط المستقيم)
অর্থাৎ মৃতের দাফনের পর তালকীন সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণিত তার সনদ দুর্বল। কিন্তু পূর্বসুরী শামের আলিমগণ এর উপর আমল করেছেন। এ কারণে আমাদের অধিকাংশ লোকদের নিকট ও অন্যান্যদের নিকট তা মুস্তাহাব। (ইকতিদাউস সিরাতাল মুস্তাকীম)
ইবনে তাইমিয়ার উক্ত মন্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসের সনদে দুর্বলতা থাকলেও অর্থাৎ হাদীস যঈফ হওয়া সত্ত্বেও তার উপর আমল করা জায়িয ও মুস্তাহাব।
হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযীওالروح কিতাবে তালকীনকে মুস্তাহাব বলেছেন।
উল্লেখ্য, আল্লাহর রাসূলের হাদীস নয় এমন কোন উক্তিকে তাঁর উক্তি বলা প্রসঙ্গে যেমন ভয়ংকর পরিণতির কথা হাদীসে উল্লেখ রয়েছে তেমনি কোন হাদীসকে হাদীস না বলাও হাদীস অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে যায়। বর্তমান সময়ে দেখা যায়, কেউ কেউ কোন কোন হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তা পরিত্যাগ করার সুযোগ অন্বেষন করেন। যেমন কোন হাদীস সম্পর্কে হাদীস বিশেষজ্ঞদের لا يصح (সহীহ নয়), لا يثبت (ছাবিত নেই) ইত্যাদি মন্তব্যকে তারা হাদীস প্রত্যাখ্যানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের এ কৌশল তাদের মুর্খতার পরিচয় প্রদান করে। কারণ উসুলে হাদীসের পরিভাষায় এসব উক্তি হাদীস অগ্রহণযোগ্য হওয়ার দলীল নয়। আল্লামা আব্দুল হাই লখনবী (র.) তাঁর লিখিত কিতাবে এ প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য হাদীস বিশেষজ্ঞদের উক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনÑ কোন কোন মুহাদ্দিসীনে কিরাম কোন হাদীস সম্পর্কেلا يصح (অসহীহ নয়) অথবা لايثبت (সাবিত নেই) মন্তব্য করেন। তা দেখে অনেক অজ্ঞ লোক এটাকে موضوع (মউযু) বা ضعيف (দুর্বল) বলে ধারণা করেন। এটি তাদের হাদীসের পরিভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতার উপর ভিত্তিশীল। মোল্লা আলী কারী (র.)تذكرة الموضوعات কিতাবে লেখেন عدم ثبوت (সাবিত নেই) কথা দ্বারা হাদীস موضوع (মউযু) হওয়াকে আবশ্যক করে না।
হাফিয ইবনে হাজার (র.) الاذكار গ্রন্থের হাদীসের তাখরীজ সম্পর্কিত তদীয় نتائج الافكار কিতাবে লেখেন- ওযুতে বিসমিল্লাহ পড়া প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমি ওযূতে বিসমিল্লাহ পড়া সম্পর্কিত কোন হাদীস জানি না। আমি বলি, কারো না জানা বাস্তবে তা না থাকা সাবিত করে না। যদি তা মেনে নেওয়াও হয় তবুও সাবিত না থাকা যঈফ হওয়াকে সাবিত করে না। কারণ হতে পারেثابت (প্রমাণিত) দ্বারাصحيح (সহীহ) বুঝানো হয়েছে, তাহলে তা حسن (হাসান) হতে পারে। যদি তাও মেনে নেয়া যায়; তাহলেও প্রত্যেক فرد এর নফী দ্বারা পুরো বিষয়টি نفي (না বাচক) হয়ে যায় না।
নূর উদ্দীন সামহুদী الشرفين فضل فى العقدين جواهر এর মধ্যে বলেন: আশুরার দিনে পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি বেশি খরচ করার হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র.)-এর উক্তি لا يصح (সহীহ নয়) দ্বারা তা বাতিল হয়ে যায় না। বরং এটি غير صحيح (সহীহ নয় এমন) হতে পারে যা দলীল হিসেবে গ্রহণের যোগ্য, যখন এটি ‘হাসান’ হবে। এর স্তর সহীহ ও যঈফ হাদীসের মধ্যখানে।
যরকশী نكت ابن الصلاح গ্রন্থে বলেন, আমাদের কথা موضوع (মউযু) ও لا يصح (সহীহ নয়) এর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কারণ প্রথমটি মিথ্যা হওয়া সাবিত করে অপরদিকে দ্বিতীয়টি সাবিত না থাকার সংবাদ দেয়। আর সাবিত না থাকা বাস্তবে না থাকা বুঝায় না। একথা এমন সকল হাদীসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যেগুলো সম্পর্কে ইবনুল জাওযী لا يصح (সহীহ নয়) বলেছেন।
মোল্লা আলী কারী বলেছেন সাখাবীর উক্তি لا يصح (সহীহ নয়) যঈফ ও হাসানকে নফী করে না।
যুরকানী বলেন- আল্লামা কাসতালানী (র.) ইবনে রজব থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবনে হিব্বান একে সহীহ বলেছেন। এতে ইবনে দেহইয়ার সেই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যাতে তিনি বলেছিলেন- ‘শাবানের মধ্যরাতের ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই।’ যদিও তিনি সহীহ দ্বারা পারিভাষিক সহীহ বুঝিয়েছেন। কারণ মু‘আয (রা.)-এর হাদীস সহীহ নয় বরং হাসান। (আর রাফউ ওয়াত তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত তা‘দীল, পৃষ্ঠা ১৯১-১৯৭)

রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৫

শাফাআত

মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

হাশরের মাঠে গোনাহগারদের জন্য রাসূল (সা.) ও নেক্কার উম্মতগণের শাফাআত হাদীসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত। খারেজী, মুতাযিলাসহ কিছু ভ্রান্ত দল শাফাআতকে অস্বীকার করেন। খারেজীদের বক্তব্য হলো কবীরা গোনাহকারী কাফির। আর কাফিরদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। মু’তাযিলারা শাফা’আতকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তাদের দৃষ্টিতে শাফাআত হলো নেক্কারদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। শাফাআতের মাধ্যমে গুনাহগারদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া অসম্ভব। বর্তমানে নব্য কিছু দল মুতলাকান গোনাহগারদের জন্য রাসূল (সা.)-এর শাফাআতকে অস্বীকার করেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো কিয়ামতের দিন রাসূল (সা.) সহ অন্যান্য নেক্কারগণ এমন গুনাহগার উম্মতের জন্য শাফাআত করবেন, যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত। সুনানে ইবনে মাজাহ-তে হযরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোক শাফা‘আত করবেন। নবীগণ, আলিমগণ এবং শহীদগণ।
শাফাআতের সর্বোচ্চ স্তর হলো শাফাআতে কুবরা। এটি রাসূল (সা.)-এর জন্য নির্দিষ্ঠ। কিয়ামতের ভয়াল মাঠের ভিষন কষ্ঠ থেকে সমস্ত মাখলূককে মুক্তি দিয়ে বিচারকার্য শুরু করার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে রাসূল (সা.) সুপারিশ করবেন। এই শাফাআত সম্পর্কে বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- যখন কিয়ামতের দিন লোকেরা সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো পেরেশান হয়ে যাবে তখন তারা আদম (আ.)-এর কাছে আসবে এবং বলবে, আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য শাফাআত করুন। তিনি বলবেন আমি এর উপযুক্ত নই, তোমরা ইবরাহীম (আ.)-এর কাছে যাও; তিনি আল্লাহর খলীল। এরপর সবাই ইবরাহীস (আ.)-এর কাছে এসে শাফাআতের জন্য আরজ করবে। তিনি বলবেন আমি এর উপযুক্ত নই, তোমরা মূসা (আ.)-এর কাছে যাও। কেননা তিনি কালীমুল্লাহ। এরপর লোকের তার কাছে আসবে এবং শাফাআতের আবেদন করবে। তিনি বলবেন- আমি এর উপযুক্ত নই। তোমরা ঈসা (আ.)-এর কাছে যাও, কেননা তিনি রূহুল্লাহ ও কালিমাতুল্লাহ। এরপর লোকেরা ঈসা (আ.)-এর কাছে আসবে এবং শাফাআতের আরজ করবে। তিনিও বলবেন আমি এর উপযুক্ত নই, তোমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট যাও। 
এরপর সবাই আমার নিকট আসবে এবং মহান আল্লাহর কাছে শাফাআতের জন্য বলবে। আমি বলব হ্যাঁ! আমি এই কাজের উপযুক্ত। অতপর আমি আমার রবের দরবারে অনুমতি চাইব, আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। এরপর আমার অন্তরে কিছু প্রশংসামূলক শব্দ তৈরী  করে দেওয়া হবে যার মাধ্যমে আমি আমার রবের প্রশংসা করব। তারপর আমি মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় অবনত হব। এরপর আমাকে বলা হবে-
 يا محمد! ارفع رأسك وقل يسمع لك وسل تعط واشفع تشفع، فأقول رب أمتي أمتي
হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনার মাথা তুলুন। আপনি বলুন আপনার কথা শুনা হবে, আপনি চান আপনাকে প্রদান করা হবে, আপনি শাফাআত করুন আপনার শাফাআত কবূল করা হবে। তখন আমি বলব- হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত।
বুখারী শরীফে অপর হাদীসে রাসূল (সা.)-এর এই বিশেষ সম্মানকে “মাকামে মাহমূদ” বলা হয়েছে।
এই শাফাআত আমাদের নবীর জন্য খাস বা নির্দিষ্ঠ। 

রাসূল (সা.) কিয়ামতের দিন তার উম্মতের মধ্যে যারা জাহান্নামী তাদের মুক্তির জন্য শাফাআত করবেন। ইবনে মাজাহ ও মুসনদে আহমদে হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা.) হতে বর্ণিত আছে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- আমাকে শাফাআত এবং আমর অর্ধেক উম্মতকে (বিনা হিনাবে) বেহেশতে প্রবেশ করানোর ব্যপারে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। আমি শাফাআত করাকে গ্রহণ করেছি, কেননা এটা অধিক ব্যাপত এবং যথেষ্ট হবে। তোমরা মনে করো না শাফাআত শুধুমাত্র মুত্তাকীদের জন্য। বরং ইহা গুনাহগার, পাপী ও অপরাধীদের জন্য।
তিরমিযী শরীফে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে-
قال رسول الله صلي الله عليه وسلم شفاعتي لأهل الكبائر من أمتي
আমার উম্মতের মধ্যে কবীরা গুনাহকারীদের জন্য আমার শাফাআত।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ দারদা (রাদ্বি.) হতেও অনুরূপ বর্ণনা আছ্।ে

অন্যান্য নবীগণের শাফাআত
ইবনে মাজাহ ও বায়হাকীতে হযরত জাবির (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যখন জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মধ্যে পার্থক্য করা হবে তখন জান্নাতীরা জান্নাতে ও জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রকেশ করবে। এরপর রাসূলগণ দাঁড়াবেন এবং (জাহান্নামীদের জন্য) শাফাআত করবেন। রাসূলদেরকে বলা হবে আপনারা যান, এবং যাদেরকে চিনেন তাদেরকে (জাহান্নাম) থেকে বের করে আনেন। অতপর রাসূলগণ এমন কিছু লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন যারা আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। তাদেরকে নদীতে নিক্ষেপ করা হবে এবং সাদা ক্কড়ার মতো হয়ে বের হবে।............................ অবশেষে যাদের অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে তাদেরকে রাসূলগণ শাফাআত করে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে নিবেন। তাদের গর্দানে লিখা থাকবে عتاء الله  মহান আল্লাহ কর্তৃক মুক্ত।
মুসনাদে আহমদ ও তাবারানীতে বর্ণিত আছে- রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে মুক্তি প্রদান করবেন। অতপর ফিরিশতা, নবীগণ, সিদ্দিকীন ও শহীদগণকে শাফাআতের অনুমতি দিবেন।

আউলিয়াদের শাফাআত
তিরমিযী শরীফে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বণিূত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক আছেন যারা তাদের সমর্থক ও অনুসারীদের শাফাআত করবেন। কিছু লোক আছেন যারা তাদের গোত্রের জন্য শাফাআত করবেন, আর কিছু লোক আছেন যারা একটি দলের জন্য শাফাআত করবেন। আর কিছু লোক আছেন যারা একক জনের জন্য শাফাআত করবেন, এভাবে সবাই জান্নাতে যাবে।

হাফিযে কুরআনদের শাফাআত
তিরমিযী শরীফে হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পাঠ করল এবং হিফয করল, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা্েবন এবং তার বংশধর থেকে এমন দশজনকে তার শাফাআতে জান্নাতে দিবেন যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত। 

শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০১৫

আল কুরআনের অনন্য খাদিম

খায়রুল হুদা খান

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ইসলামের বহুমাত্রিক খিদমতের এক মহাপুরুষ, যিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করে গেছেন দীনের তরে, ইসলামের তরে, সমাজের মানুষের উন্নতির লক্ষ্যে। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানুষের কল্যাণ হতে পারে এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যাতে তিনি সময় এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করেন নি। খিদমতে খালক তথা সৃষ্টির সেবা, মানবসেবা, ইসলাম প্রচার, দীনের খিদমত, কুরআনের খিদমত, হাদীসের খিদমত, অসত্য-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সৎকাজে মানুষকে উৎসাহিত করণ, সুসাহিত্য চর্চা ইত্যাদি মানব কল্যাণের সকল ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর সরব পদচারণা। তাঁর এসকল খিদমতের একেকটির বর্ণনা দিয়ে এক একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব। আলোচ্য নিবন্ধে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র কুরআনের খিদমত সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কুরআনের খিদমত করেছেন নানাভাবে। কুরআনের খিদমতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে কুরআন পাকের সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা প্রদান। ছাহেব কিবলাহ এমন এক সময় তাঁর এই খিদমত আরম্ভ করেন যখন এই উপমহাদেশে কুরআন তিলাওয়াতে নানা অসামঞ্জস্যতা দেখা দিয়েছিল। কুরআনের হরফ বিকৃতি, ভুল উচ্চারণসহ অনেক ধরনের ভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনি সময়ে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা দিতে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ’র নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে উপমহাদেশের মানুষ আজ কুরআনের সঠিক তিলাওয়াত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
হযরত ছাহেব কিবলাহ ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় যখন শিক্ষকতায় নিয়োজিত, তখন তাঁর মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোহম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র) তাঁকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেন। উল্লেখ্য, হযরত বদরপুরী (র.) উলামায়ে কিরামকে কিরাত বিশুদ্ধ করার জন্য তাকীদ দিতেন। কিরাত শুদ্ধ না হলে নামায শুদ্ধ হয় না, আর নামায বিশুদ্ধ না হলে কোন ইবাদতই কবূল হয় না, তাই কিরাত শুদ্ধ করা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। উলামা সাধারণের প্রতি বদরপুরী ছাহেব কিবলাহর এ ছিল এক বিশেষ নসীহত। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর কিরাতে বদরপুরী ছাহেব সন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ ছাহেব কিবলাহ স্বীয় মুরশিদ বদরপুরী (র)-এর খিদমতেই কিরাতের তালীম নিয়েছিলেন। হযরত বদরপুরী (র.) কেবল আলিম ও পীর ছিলেন না; বরং সনদপ্রাপ্ত কারীও ছিলেন। তাঁর কিরাতের উস্তাদ হলেন হযরত শায়খ মাওলানা আদুল মজিদ (র.), তিনি সনদ লাভ করেছিলেন হযরত শায়খ মাওলানা আব্দুল ওহাব সিলেটী (র.)-এর কাছ থেকে। তাঁর সনদের সিলসিলা আবূ আমরিদ্দানী (র.) হয়ে রাসূলে কারীম (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। হযরত বদরপুরী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে কিরাতে আরও মাহির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে ফুলতলী ছাহেবকে ইলমে কিরাতের মহান খিদমতের এক গুরুদায়িত্ব আনজাম দিতে হবে। আর তজ্জন্য তাঁকে অর্জন করতে হবে এই বিষয়ে আরও উচ্চতর সমৃদ্ধি।
মুরশিদ কিবলাহর নির্দেশ পেয়ে তিনি হযরত মাওলানা হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে পর্যায়ক্রমে সমস্ত কুরআন শরীফের তিলাওয়াত শুনিয়ে সনদ লাভ করেন। হযরত মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.) শৈশবকাল থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত পিতা-মাতার সাথে মক্কা শরীফে অবস্থান করে ইলমে কিরাত শিক্ষা করেন এবং কুরআন শরীফ হিফয করেন। ইলমে কিরাতে তাঁর উস্তাদ ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কারী ইরকসূস মিসরী (র.)। হযরত ইরকসূস মিসরী (র.) থেকে রাসূল (সা.) পর্যন্ত সনদের ধারাবাহিতা এখানে উল্লেখ করা হল। ৩) হযরত ইরকসূস মিসরী (র.), ৪) শায়খুল কুররা হযরত আবদুল্লাহ আল মক্কী (র.), ৫) হযরত কারী ইবরাহীম সা’দ মিসরী (র.), ৬) হযরত হাসান বাদবার শাফিঈ (র.),  ৭) হযরত মুহাম্মদ আল মুতাওয়াল্লী (র.), ৮) হযরত সায়্যিদ আহমদ তিহামী, ৯) হযরত আহমদ সালমুনা, ১০) হযরত ইবরাহীম আল ‘উবায়দী, ১১) হযরত আবদুর রহমান আল আজহুরী, ১২) হযরত শায়খ আহমদ আল বাকারী, ১৩) হযরত শায়খ মুহাম্মদ আল বাকারী, ১৪) হযরত আবদুর রহমান আল ইয়ামনী, ১৫) হযরত শায়খ শাখ্খাজা, ১৬) হযরত শায়খ আবদুল হক ছানবাতী, ১৭) হযরত শায়খুল ইসলাম জাকারিয়া আল আনসারী, ১৮) হযরত শায়খ দেওয়ান আল আকারী, ১৯) হযরত শায়খ মুহাম্মদ আননাওয়েরী, ২০) হযরত ইমাম মুহাম্মদ আল জাযারী, ২১) হযরত শায়খ ইবনুল লাব্বান, ২২) হযরত শায়খ আহমদ ছিহরা আশশাতবী, ২৩) হযরত শায়খ আবুল হাসান আলী ইবনে হুদাইল, ২৪) হযরত শায়খ আবূ দাঊদ সুলায়মান ইবনে নাজ্জাহ, ২৫) হযরত ইমাম আবূ আমরিদ্দানী, ২৬) হযরত আবুল হাসান তহির ইবনে গালিউন, ২৭) হযরত সালিহ আল-হাশিমী, ২৮) হযরত আহমদ আল উশনানী, ২৯) হযরত মুহাম্মদ ‘উবায়দ আল সাব্বাহ, ৩০) হযরত ইমাম হাফস (র.), ৩১) হযরত ইমাম আছিম ইবন আবুন নুজদ আল কূফী, ৩২) হযরত আবূ আব্দিল্লাহ ইবনে হাবিব আস সালামী ও যুর ইবনে হাবিশ, ৩৩) আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.), হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.), ৩৪) সাইয়িদুল মুরসালীন, শাফিউল মুযনিবীন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের লাওহে মাহফুয থেকে। (সূত্র : আল-কাউলুছ হাদীছ)
১৯৪৪ইং (১৩৫১ বাংলা) সনে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফে যান এবং কিরাতের আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন মিসরীয় বংশোদ্ভূত রাঈসুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (র.)-এর নিকট থেকে। তিনি ছিলেন হারাম শরীফের ইমামগণের পরীক্ষক ও মক্কা শরীফের ফকীহ। তিনি যে কারী ছাহেবের কিরাত বিশুদ্ধ বলে অনুমোদন করতেন তাকেই হারাম শরীফে কিরাত পাঠ করার  অনুমতি দেয়া হত। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে কিরাত শুনানোর অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি ছাহেব কিবলাহ ভারত থেকে এসেছেন জানতে পেরে তাঁর কিরাত শুনতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। কারণ তৎকালীন সময়ে ভারতে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ছিল না বললেই চলে। ছাহেব কিবলাহ জানালেন তিনি হযরত হাফিয মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)-এর নিকট কিরাত শিক্ষা করেছেন যিনি ইরকসুস মিসরী (র.)  এর ছাত্র। আহমদ হিজাযী (র.) করমপুরী (র.)-কে চিনতে না পারলেও ইরকসূস মিসরী (র.)-কে চিনতে পারলেন এবং ছাহেব কিবলাহ’র কিরাত শুনতে সম্মত হলেন। হযরত আহমদ হিজাযী (র.) কিরাতের সনদ লাভ করেছিলেন হযরত আহমদ আদ-দারদীর (র.)-এর কাছ থেকে। তিনি সনদ লাভ করেছিলেন হযরত আযহার শরীফ (র.)-এর কাছ থেকে। তাঁরও সনদ হযরত আবূ আমরিদ্দানী (র.) হয়ে রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র অনন্য সাধারণ গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে একটি ছিল শিক্ষা জীবনে মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বীয় মুরশিদ থেকে তরীকতের খিলাফত লাভ আর অন্যটি ছিল রাঈসুল কুররা আহমদ হিজাযী (র.)-এর ভারত উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সনদ প্রাপ্ত ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা। সনদ প্রদান করে হযরত আহমদ হিজাযী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে ওসীয়ত করে বললেন, ‘এটা একটি আমানত, যে আমানত আমার ইলমে কিরাতের উস্তাদ ও বুযুর্গগণ আমার হাতে রেখেছিলেন। আজ আমি তা তোমার হাতে সোপর্দ করলাম। যদি এই আমানতের হ্রাস-বৃদ্ধিজনিত খেয়ানত কর, তবে তার পরিণাম ফল তুমিই ভোগ করবে। কারণ আজমে (আরব ছাড়া অন্যান্য দেশ) এখন হরফের উচ্চারণ ও পঠন পদ্ধতি বিষয়ে নানারকম মতভেদ দেখা দিয়েছে।’
ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফ হতে ফিরে পুনরায় যথারীতি বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাদান শুরু করেন। একদিন হযরত ছাহেব কিবলাহ ক্লাসে ছাত্রদের দারস দেয়ার সময় সেখানে হযরত মাওলানা আব্দুন নূর গড়কাপনী (র.) তাশরীফ নিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন তিনি । ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁকে সমাদরে পাশে বসতে অনুরোধ করে পাঠদানে ব্যস্ত হলেন।  ক্লাসের সময় শেষ হলে ছাহেব কিবলাহ তাঁর কুশলাদি ও আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি  বললেন, সর্বসাধারণ তো দূরের কথা এতদঞ্চলের বেশ সংখ্যক আলিমেরও কিরাত শুদ্ধ নয় । তাই ছাহেব কিবলাহ দারসে কিরাতের জন্য অন্তত সপ্তাহে এক ঘণ্টা সময় যেন দেন আমাদের। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ জবাবে বললেন, আমার হাতে সময় একেবারে কম, বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্রদের পাঠদানের আগে নিজে ভালোভাবে তা দেখে নিতে হয়, তাই সময় দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। এ কথার পর আব্দুন নূর ছাহেব চলে গেলেন। 
পরদিন ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়ে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলে ছাহেব কিবলাহ আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হযরত আব্দুন নূর (র.) বললেন, আমি নিজে থেকে আপনার নিকট আসিনি। বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েই তবে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন স্বীয় মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.) এর নির্দেশ কিনা জানতে চাইলে হযরত আব্দুন নূর (র.) বললেন, না আরো বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েছি। ছাহেব কিবলাহর পীড়াপীড়িতে তিনি বর্ণনা করলেন, আমি স্বপ্নে হুযূর (সা.)-এর দীদার লাভ করি। হুযূর (সা.)-এর কন্ঠে সুললিত তিলাওয়াতে কালামে পাক শুনতে পাই। আরয করলাম, ইয়া রাসূল্লাল্লাহ (সা.), এই কিরাত কিভাবে শিখব? তখন নবী পাক (সা.) ডান দিকে যাকে ইশারা করলেন, চেয়ে দেখি সেই সৌভাগ্যবান আপনি। একথা শোনার সাথে সাথে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কেঁদে ফেললেন এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পরে নিকটবর্তী হযরত আদম খাকী (র.)  (তিনশত ষাট আউলিয়ার অন্যতম)-এর মাযার সংলগ্ন মসজিদে কিরাতের দারস দেওয়ার ওয়াদা দিলাম। এভাবেই ছাহেব কিবলাহর ইলমে কিরাতের খিদমতের সূত্রপাত। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেটে, ঘোড়ায় চড়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবৈতনিকভাবে কিরাতের দারস দিয়েছেন। যখনই যে অঞ্চলে যেতেন স্থানীয় উলামা-মুদাররিসীন কিরাত শিক্ষার জন্য জমায়েত হয়ে যেতেন। ছাহেব কিবলাহ ধৈর্য সহকারে তাদেরকে কিরাতের মশক দিতেন। ফলে সিলেট ও আসাম অঞ্চলের খ্যাতনামা আলিমগণ তাঁর নিকট থেকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষা করে উপকৃত হয়েছেন। ভারত বিভক্তির পর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বারগাত্তা, কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্বনাথের সৎপুর আলিয়া মাদরাসায় কিরাত শিক্ষা দিয়েছেন।
১৯৫০ ইংরেজি সনে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রথম চালু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন রামাদান মাসকে কিরাত শিক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়। আর রামাদান মাস যেহেতু নুযূলে কুরআনের মাস, তাই প্রতি বৎসর রামাদানে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থী আলিমদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজ খরচে বহন করতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, রান্না-বান্না সবকিছু নিজে তদারকি করতেন। এমনকি নিজে রান্না করে খাইয়েছেন শিক্ষার্থীদেরকে। পঞ্চাশ হতে একশত এভাবে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি সকলকে তালীম দিয়ে এবং সমগ্র কুরআন শরীফ নিজে শুনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী করে তবেই সনদ প্রদান করতেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় অন্যান্য স্থানে শাখাকেন্দ্র অনুমোদন ও একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধক্রমে ছাহেব কিবলাহর ওয়ালিদ মুহতরম হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল মজিদ চৌধুরী মুজাদ্দেদী বরকতী (র.)-এর নামানুসারে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। হযরত ছাহেব কিবলাহ শুরু থেকেই ছিলেন এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় দপ্তর বা বোর্ড অফিস ফুলতলী ছাহেব বাড়ি থেকে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব বিল্ডিং থেকে বছরব্যাপী এর প্রস্তুতি চলতে থাকে। বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে এ পর্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাঁরই বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। ছাহেব কিবলাহ তাঁর ভূ-সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর) এই ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। ছাহেব কিবলাহর জীবদ্দশায়ই এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় এক হাজার শাখা কেন্দ্র বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সকল শাখার মাধ্যমে প্রতি বছর রামাদানে বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা লাভ করে থাকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত ট্রাস্টের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে সকল শাখার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতি রামাদানে বোর্ডের সর্বশেষ জামাত ‘ছাদিছ’-এর পাঠদান ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থিত প্রধানকেন্দ্রে পরিচালিত হয়। হাজার হাজার ছাত্র মাসব্যাপী এখানে অবস্থান করে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র নিকট থেকে ইলমে কিরাতের দারস গ্রহণ করেছেন। লাভ করেছেন পরিপূর্ণতার সনদ। সনদপ্রাপ্ত কারীসাহেবগণ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেন বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের সুর। এত বিশাল সংখ্যক মানুষ কোন এক ব্যক্তির কাছে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিখতে পেরেছে এমন নযীর পৃথিবীতে হয়তো দ্বিতীয়টি নেই।
ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ছাহেব কিবলাহ প্রতি রামাদান মাসে নিজ বাড়ি ফুলতলীতে অবস্থান করে আগত হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়মিত কিরাত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন ছিল তাঁর এই খিদমত। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিরাত প্রশিক্ষণ দিতেন। বাদ যুহর কিছুক্ষণ তাফসীর বয়ান করতেন। রামাদান ছাড়াও সপ্তাহে দু’দিন শনি ও রবিবার বাদ যুহর ছাহেব বাড়ি জামে মসজিদে ফুলতলী কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও সমবেত মুসল্লীদের এবং প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাযের পূর্বে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাটে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত হাজী নওয়াব আলী জামে মসজিদে সোবহানীঘাট কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও সমবেত মুসল্লীদের তিনি নিয়মিত কিরাত প্রশিক্ষণ দিতেন।
কিরাতের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন ইলমে তাজবীদের উপর সহায়ক গ্রন্থ। মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কিরাত শিক্ষা দেয়া আরম্ভ করেন। তাজবীদের নিয়মাবলী শিক্ষার্থীদেরকে বলে দিতেন। কিন্তু এর দ্বারা সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে সকল নিয়মাবলী আয়ত্ত্ব করা সম্ভব হতনা। তাই আল্লামা ছাহেব কিবলাহ উর্দু ভাষায় রচনা করলেন ‘আল কাউলুছ ছাদীদ’ নামে অত্যন্ত সুরচিত ও সহজবোধ্য তাজবীদের কিতাব, যা বর্তমানে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আল কুরআনের সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা অর্জনে সহায়ত করে আসছে।
ফুলতলীতে অবস্থান করে যারা কিরাত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা দেখেছেন কুরআনের এই খিদমতে আল্লামা ছাহেব কিবলাহর আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা। সময় হওয়ার আগেই ক্লাসে উপস্থিত হওয়া, তুলনামুলক দুর্বল ছাত্রদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন আদর্শ অভিভাবক।
আল কুরআনের খিদমতের আরেকটি দিক হচ্ছে কুরআনের হুকুম-আহকাম, বিধানাবলী মানুষকে শিক্ষা দেওয়া, শিক্ষা অর্জনে অনুপ্রাণিত করা। আল কুরআনের এই খিদমতেও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র রয়েছে অনন্য অবদান। তিনি নিজে একজন সুবক্তা হিসেবে দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন মাহফিলে আল কুরআনের হুকুম আহকাম, ইসলামের সঠিক আকীদা-বিশ্বাসকে জনসমাজে তুলে ধরেছেন। মানুষকে দেখিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। বার্ধক্যে উপনীত হয়েও দীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও ইকামতে দীনের সুকঠিন দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো বিচলিত হন নি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর খিদমত কেবল ইলমে কিরাতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি এর পাশাপাশি ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইলমে তাসাওউফসহ সকল বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করে তাঁর অমীয় সুধা বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি রচনা করেছেন আল কুরআনের তাফসীর বিষয়ে সমৃদ্ধ দালীলিক গ্রন্থ ‘আত তানভীর আলাত তাফসীর’, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা নির্ভর বারো চাঁদের খুতবা ‘আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া’সহ অনেক গ্রন্থ। আল কুরআন, আল হাদীস ও ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য ইসলামী প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কুরআন, হাদীস ও ফিকহের দারস প্রদান করেছেন দীর্ঘকাল। প্রাতিষ্ঠানিক গ-ির বাইরে থেকেও বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসায় ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ইলমে হাদীসের দারস দিয়ে গেছেন। ইলমে তরীকত, শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি। গঠন করে গেছেন অসংখ্য আলিমে দীন। রেখে গেছেন তাঁর সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর দীনী সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকুক, তাঁর সকল খিদমত কবূল হোক আল্লাহর দরবারে, এই কামনা আমাদের। আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁর রেখে যাওয়া সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কাজ করে যাওয়ার তাওফীক দান করুন।

[লেখক : ইমাম ও খতীব, শাহজালাল মসজিদ এন্ড ইসলামিক সেন্টার
ম্যানচেস্টার, ইউকে]
 

সাহাবায়ে কিরামের তাকলীদ

আল্লামা মুফতী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী

সাহাবায়ে কিরামের যুগে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে অভিজ্ঞ, ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের তাকলীদ প্রচলিত ছিল যা মওকুফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তন্মধ্যে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হল।
০১। হযরত উমর (রা.)-এর নির্দেশ:
عَن عكرمةَ عن بن عباس قال خطب عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ خَطَبَ النَّاسَ بِالْجَابِيَةِ فَقَالَ : مَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقُرْآنِ فَلْيَأْتِ أُبَىَّ بْنَ كَعْبٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفَرَائِضِ فَلْيَأَتِ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفِقْهِ فَلْيَأْتِ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْمَالِ فَلْيَأْتِنِى فَإِنَّ اللهَ تَعَالٰى جَعَلَنِى لَهُ والِيًا وَقَاسِمًا.
অর্থাৎ হযরত ইকরামাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাবিয়া নামক স্থানে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এক ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের যে কুরআন (ইলমে কিরাত) সম্পর্কে জানতে চায়, সে যেন হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.)-এর কাছে যায়। ফরাইয সম্পর্কে জানতে চাইলে যেন হযরত যায়দ বিন সাবিত (রা.)-এর কাছে যায়। ফিক্হ সম্পর্কে জানতে চাইলে মুআয বিন জাবাল (রা.)-এর কাছে যায়। আর অর্থ সম্পর্কিত কিছু জানতে চাইলে আমার কাছে আসবে। কারণ আল্লাহ আমাকে সম্পদের ওয়ালী ও বন্টনকারী করেছেন।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায়, যে যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়ে তার তাকলীদ করা যাবে।
২। ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রা.)-এর হাদীস:
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ الرَّجُلِ يَكُونُ لَهُ الدَّيْنُ عَلَى الرَّجُلِ إِلَى أَجَلٍ فَيَضَعُ عَنْهُ صَاحِبُ الْحَقِّ وَيُعَجِّلُهُ الْآخَرُ فَكَرِهَ ذَلِكَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ وَنَهَى عَنْه.
অর্থাৎ হযরত সালিম বিন আব্দুল্লাহ (র.) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণনা করেন- তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে যে অন্য এক জনের কাছে মেয়াদী ঋণে পাওনাদার ছিল। এখন সে মেয়াদের পূর্বে পরিশোধের শর্তে কিছু ছাড় দিতে রাজী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তা অপছন্দ করলেন এবং এরূপ করতে নিষেধ করলেন। (মুসনাদে ইমাম মালিক)
উক্ত হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) নিজের কথার সমর্থনে কোন আয়াত বা মারফু হাদীস উল্লেখ করেননি। সুতরাং বুঝা যায় এটা তার নিজস্ব ইজতিহাদ। আর প্রশ্নকর্তা তাঁর ইজতিহাদী ফতওয়াকে দলীল-প্রমাণ তলব ছাড়াই মেনে নেন।
৩। হযরত সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রা.) মসজিদে নামায আদায় করলে রুকু, সিজদা ও সালাত সংক্ষিপ্ত অথচ পরিপূর্ণরূপে করতেন। কিন্তু বাড়িতে নামায আদায় করলে তা দীর্ঘ করে আদায় করতেন। তাঁর ছেলে হযরত মুসআব (রা.) এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন-
يَا بُنَي ، إِنَّا أَئِمَّةٌ يُقْتَدَى بِنَا. (إتحاف الخيرة المهرة ، مُصنف ابن أبي شيبة)
অর্থাৎ হে আমার বৎস! আমরা হলাম ইমাম, আমাদের অনুসরণ করা হয়।
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় হযরত সা’দ (রা.)-এর নামায দীর্ঘ হলে তা দেখে লোকেরা মনে করবে এরূপ করা জরুরী এবং তারা তাঁকে দলীল জিজ্ঞেস না করেই আমল শুরু করে দিবে, যা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
৪। ইহরাম অবস্থায় হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.)-এর গায়ে রঙ্গীন কাপড় দেখে হযরত উমর (রা.) তাঁকে এরূপ কাপড় পরিধানের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হযরত তালহা (রা.) জবাব দিলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, এ রং-এ ঘ্রাণ নেই। আর ঘ্রাণ না থাকলে রঙ্গীন কাপড় পরিধান করতে কোন বাঁধা নেই।  জবাবে হযরত উমর (রা.) বলেন-
إِنَّكُمْ أَيُّهَا الرَّهْطُ أَئِمَّةٌ يَقْتَدِى بِكُمُ النَّاسُ فَلَوْ أَنَّ رَجُلاً جَاهِلاً رَأَى هَذَا الثَّوْبَ لَقَالَ : إِنَّ طَلْحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ قَدْ كَانَ يَلْبَسُ الثِّيَابَ الْمُصْبَغَةَ فِى الإِحْرَامِ فَلاَ تَلْبَسُوا أَيُّهَا الرَّهْطُ شَيْئًا مِنْ هَذِهِ الثِّيَابِ الْمُصْبَغَةِ. (موطأ الإمام مالك)
অর্থাৎ আপনারা হলেন ইমাম। লোকজন আপনাদের অনুসরণ করে। যদি কোন অজ্ঞ লোক এ পোশাক দেখে তা হলে বলবে, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.) ইহরাম অবস্থায় রঙ্গীন কাপড় পরিধান করতেন। সুতরাং আপনারা এরূপ রঙ্গীন কাপড় পরিধান করবেন না।
০৫। হযরত আম্মার বিন ইয়াসির ও আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-কে হযরত উমর (রা.) কুফায় প্রেরণ করেন। তাদের সাথে কুফাবাসীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দেন। চিঠির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:
إني قد بعثت إليكم بعمار بن ياسر أميرا وابن مسعود معلما ووزيرا وهما من النجباء من أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم فاقتدوا بهما واسمعوا من قولهما. (تاريخ مدينة دمشق وذكر فضلها)
-আমি তোমাদের কাছে আম্মার বিন ইয়াসির (রা.)-কে আমির এবং আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-কে শিক্ষক ও ওযীর হিসেবে পাঠালাম। তাঁরা দু’জনই হলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশিষ্ট দুই বদরী সাহাবী। সুতরাং তাঁদের ইকতিদা করবে ও যাবতীয় নির্দেশ মেনে চলবে।
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের যুগে তাকলীদ প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল। এমনকি স্বয়ং দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবীকে অনুসরণের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছেন। যদি তাকলীদ বৈধ না হতো তাহলে উমর (রা.) এরূপ ঘোষণা দিতেন না। এমনিভাবে সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর যুগ থেকে তাবিঈ, তাবে তাবিঈনের যুগ ধরে সর্বযুগে তাকলীদ চলে আসছে। সুতরাং তাকলীদ শিরক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না বরং তা জরুরী, বিশেষ করে গায়র মুজতাহিদ আলিমের জন্য তা অপরিহার্য।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু লোক নিজেদেরকে সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী মনে করে বলতে থাকে- শরীআতের মূলনীতি হল কুরআন ও হাদীস। এর বাইরে কোন কিছু মানা যাবে না। তারা কোন ইমামের অনুসরণ বা তাকলীদকে র্শিক বলতে শুরু করলো। তাদের কেউ কেউ আবার সহীহ হাদীস অনুসরণের কথা বলে কেবল বুখারী শরীফে সংকলিত হাদীসের উপর আমল করতেই বেশি আগ্রহী। অথচ বাস্তবে দেখা যায় বুখারী শরীফের অনেক হাদীসের উপরও তাঁদের আমল নেই। ইমাম বুখারী (র.)-এর মতের সাথে তাদের মতামতের কোন মিল নেই। এমনকি পরবর্তী যুগের গায়র মুকল্লিদগণ তাদের পূর্বসূরীদের অনেকের মতামতকে অশালীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেন, অথচ হাদীসের কিতাব বলতে তারা বুঝেন কেবল বুখারী ও কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিম শরীফ। এছাড়া হাদীসের কিতাবকে তারা আমলে আনেন না। তাদের এ আচরণ স্ববিরোধী ও ভ্রান্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
[সূত্র : তাকলীদ-এর সুদৃঢ় রজ্জু]

বুধবার, ১১ মার্চ, ২০১৫

নজরুলীয় দুর্বিনয় : শেষ কোথায়?


মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান


“বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির”
নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গগনবিদারী উচ্চারণ আর জাগরণের মন্ত্রে দীপ্ত বিদ্রোহের এ গানটি লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই তিনি বিদ্রোহী কবি। তাঁর সাহিত্য বিচারে কেউ তাঁকে বলেছের সাম্যের কবি, কেউ বলেছেন মানুষের কবি, মানবতার কবি। কেউ বলেছেন প্রেমের কবি আবার কেউ বলেছেন ইসলামী রেনেসাঁ বা জাগরণের কবি। মূলত তিনি একই সঙ্গে সকল অভিধায় অভিষিক্ত হবার পূর্ণ দাবি রাখেন। তাঁর কাব্য বিচার-বিশ্লেষণে যে কেউই এটা স্বীকার করবেন।
আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে কবি নজরুল এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। যেহেতু সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অনিশ্চিত, বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল পরিবেশের সাক্ষী হয়ে কবি প্রতিভার সূত্রপাত সেহেতু তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘশ্বাস, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ট বিদ্রোহ। বঞ্চিতের প্রতি নিবিড় সহানুভূতি নিয়ে কবির চেতনার গভীরে যে ক্ষোভ অসহনীয় উত্তাপে ফুটে উঠেছিল তা প্রকাশের তীব্র আকুতিই তাঁর কাব্য প্রেরণার মূল উৎস। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আরো বঞ্চিত করে বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ করে যে আইন, কবি ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি ঘোষণা করেন :
“আমি দূর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল
আমি দলে যাই যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।”
মূলত কবির বিদ্রোহী উচ্চারণ শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিবাদ। এ সংগ্রামী প্রতিবাদ থেকে কবি তখনই শান্ত হবেন যখন অবসান ঘটবে  সকল অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার। কবির ভাষায় :
“আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়নের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।”
কবি নজরুলের প্রতিবাদী এমন অনেক কবিতা পড়ে তাঁকে কেউ কেউ ‘বেপরোয়া’ ভাবলেও তাঁর এ বেপরোয়া বিচরণের একটি সীমারেখা আছে। এ সীমারেখা চিহ্নিত করেছেন প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ইসহাক সিদ্দীকী তার ‘নজরুলীয় দুর্বিনয় : মনস্তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ নামক এক প্রবন্ধে এভাবে- “কিন্তু আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দটির সাথে সাথে নজরুলীয় ঔদ্ধত্য লিপ্ত হয়নি কখনো তাঁর কবিতা কিংবা গানে। অথচ তাঁর ইসলামী ও মরমী রচনাবলীতে এ শব্দের রয়েছে সুনির্মল, ¯িœগ্ধ ও পরম সম্মানিত স্থান, যা সমস্ত ক্রোধ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, ঘৃণা ও স্বেচ্ছাচারের উর্ধ্বে। আমরা জানি, কাল-পাত্র নির্বিশেষে মুসলিম মানসে আল্লাহ নামের যে অনন্য মাহাত্ম্য ও ব্যঞ্জনা এর বিকল্প পরমার্থিক অন্য কোনো নামে নেই, বিভাষা তো দূরের কথা। এ দিক থেকে দেখতে গেলে পরম সত্তার নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী সেই জন্মগত ভেদজ্ঞান চরম দুর্বিনয় প্রকাশের কালেও নজরুলকে রেখেছিল সুরক্ষিত ও সচেতন।”
কাজী নজরুল ইসলাম স্বীয় বক্তব্যেও আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন তাঁর বক্তব্যে আছে :
১. আল্লাহ আমার প্রভূ। রাসুলের আমি উম্মত, আল কোরআন আমার পথপ্রদর্শক।
২. বিদ্বেষ আমার ধর্মবিরুদ্ধ। আমার আল্লাহ নিত্য পূর্ণ পরম অভেদ্য, নিত্য পরম প্রেমময়, নিত্য সর্বদ্বন্ধাতীত। কোনো ধর্ম, কোনো জাতি বা মানবের প্রতি বিদ্বেষ আমার ধর্মে নাই, কর্মে নাই, মর্মে নাই। মানুষের বিচারকে আমি স্বীকার করি না, ভয়ও করি না। আমি একমাত্র পরম বিচারক আল্লাহ ও তাঁর বিচারকে জানি। (আমার লীগ কংগ্রেস)
কবি স্বীয় কবিত্বশক্তিকেও আল্লাহর দান হিসেবে স্বীকার করে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। তিনি বলেছেন : আমার কবিতা আমার শক্তি নয়, আল্লাহর দেওয়া শক্তি। আমি উপলক্ষ মাত্র। বীণার বেণুতে সুর বাজে, কিন্তু বাজান যে গুণী সকল প্রশংসা তাঁরই।
অসংখ্য কবিতা ও গানেও কবি আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং তাঁরই হামদ গেয়েছেন। সর্বোপরি সকল হিংসা-বিদ্বেষ ও স্বেচ্ছাচারিতার উর্ধ্বে এক আল্লাহতে আত্মনিবেদন করত তাঁর উপর তাওয়াক্কুল তথা পূর্ণ ভরসা রেখেছেন। কবি দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করেন :
“উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।”

শেষ কথা হলো, কবি নজরুল স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের শাসন-শোষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন। তাই তাঁর অনেক কবিতা ও গানে দ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছে, চরম দুর্বিনয় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা ও বক্তব্যে। কিন্তু এ দুর্বিনয় ও বেপরোয়া বিচরণ আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দের সাথে লিপ্ত হয়নি। মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থা।

শনিবার, ৭ মার্চ, ২০১৫

তাঁর চেহারা ছিল জ্যোতির্ময়


মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
রাসূলে আরাবী (সা.)-এর চেহারার বর্ণনায় বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবীয়ে আকরাম (সা.) এর চেহারা পৃথিবীর সকল মানুষ থেকে অধিক সুন্দর ছিল। তার সেই নূরানী চেহারাতে যেন সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হতো। (তিরমিযী)
মহান আল্লাহ তা‘আলা হলেন সকল সুন্দর্যের আধার। আল্লাহ নিজে সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। সকল রূপ-সৌন্দর্যের ¯্রষ্টা, যিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন তিনি তার হাবীবকে কেমন সুন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? কেমন রূপের বাহার ছিল তার মাহবূবের চেহারাতে? হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আমি ছিলাম গুপ্ত ভান্ডার। আমি ইচ্ছা করলাম প্রকাশিত হওয়ার, আর সে জন্যে আমি এক মাখলূক সৃষ্টি করলাম যার নাম দিলাম মুহাম্মদ (সা.)।
মহান আল্লাহ তার যাত-সিফাত, জামাল-কামাল কে প্রকাশিত করার জন্যে মুহাম্মদ (সা.) কে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মহান আল্লাহর সেই জামাল কেমন রূপে তার হাবীবের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল?
ইবনে আসাকির জাবির (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- আমার কাছে জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন আল্লাহ পাক আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আর বলেছেন- হে আমার হাবীব! আমি নবী ইউসুফ (আ.) কে আমার কুরসীর নূর দ্বারা সুন্দরর্যমন্ডিত করেছি। আর আপনার চেহরায়ে আনওয়ারে আমার আরশের নূর প্রদান কিেছ। (খাসায়িসুল কুবরা)
হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন-
لواحي زليخا لو رأين جبينه + لأثرن بالتقطيع الصدور علي اليد
-যদি যুলায়খার সঙ্গী-সাথীরা আমার নবীর নূরানী চেহারা দেখত, তাহলে তাদের নিজ হাতে তাদের কলিজা কেটে দিত। (খাসায়িস)
প্রিয় নবীর একান্ত সহচর গারে সূরের সাথী হযরত আবূ বকর (রা.) বলেন-
كان وجه رسول الله صلي الله عليه وسلم كأنه دارة
-রাসূল (সা.)-এর চেহারা যেন একরাশ তারকার ন্যায় ছিল।
নূরে মুজাস্সাম হাবীবে কিবরিয়া (সা.)-এর চেহারার সুন্দর্য সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা হলো- তার চেহারা ছিল উজ্জলতম, পুষ্পিত আলোকময়, দৃশ্যমান এক জ্যোতি, পূর্ণিমার রাতের আলার ন্যায় ঝলমলে। হযরত জাবির (রা.) এক পূর্ণিমার রজনীতে রাসূল (সা.) এর চেহারার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলেন আমি একবার প্রিয়নবীর চেহারার দিকে তাকাই আরেকবার আকাশের চন্দ্রের দিকে তাকাই। অবশেষে আমি এটা নিশ্চিত হলাম যে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দর।
অন্ধকার আলোতে প্রিয়নবীর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন-
আমি রাতের বেলা সেলাই করছিলাম। হঠ্যাৎ আমার হাত থেকে সূঁই পড়ে গেল। অনেক খোঁজাখোঁজি করেও সুঁই পাইনি। এমন সময় রাসূল (সা.) আমার ঘরে তাশরীফ আনেন। তার আলোকোজ্জল চেহারার আলোতে আমি আমার সুঁই পেয়ে যাই।
আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (সা.)-এর মধ্যে জাহেরী-বাতেনী সকল ধরনের সৌন্দর্যের সমাহার ঘটিয়েছেন, যা পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত কারো মধ্যে ঘটান নি। তার মধ্যে বাতেনী সুন্দর্যের মতো জাহেরী সুন্দের্যের অনন্য সমাহার ছিল। প্রিয়নবীর সেই জাহেরী সুন্দর্য দেখে অসংখ্য কাফের মুসলমান হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-এর জাহেরী সুন্দর্য চর্মচক্ষে অবলোকন করেছেন। যার জন্য তারা রাসূল (সা.)-এর পদ্বতলে তাদের জীবন কুরবান করে দিয়েছেন। এমনকি উদ্ভিদ-প্রাণীরাও তার ভালোবাসায় প্রাণ উৎসর্গ করেছে। বিদায় হজ্জের দিন রাসূল (সা.) ৬৩ টি কুরবানী নিজ হাতে দিয়েছেন। কুরবানীর উটগুলো রাসূল (সা.)-এর প্রিয় হাতে তাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, কার আগে কে কুরবানী হবে। প্রিয়নবীর ইন্তেকালের পর তার নূরানী চেহারার দর্শন না পেয়ে বেদনায় তার গাধাটি কূপের মধ্যে পড়ে প্রাণ দিয়ে দেয়। রাসূল (সা.)-এর উষ্ট্রি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। অবশেষে মারা যায়।
কি অলৌকিক আকর্ষন ছিল তার চেহারায়? ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে সাহাবায়ে কিরাম তার মজলিসে বসতেন। নবীজীর নূরানী চেহারার দিকে তাকিয়ে তারা তাদের ক্ষুধাকে নিভৃত করতেন। শত দুঃখ, কষ্ঠ, যন্ত্রনা দূর করতেন। এক মহিলা সাহাবীর স্বামী, দুই সন্তান জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তিনি সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। তিনি বার বার বলতেছিলেন আমার নবীর অবস্থা কি? তিনি কেমন আছেন? (সুবহানাল্লাহ)
রাবী‘ বিনতে মুআওয়িয বলেন- لو رأيته لرأيت الشمس طالعة
-আমি যখন রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকাতাম তখন মনে হতো যেন উদিত সূর্যের দিকে তাকাচ্ছি। (তিরমিযী)
হযরত আবূ তোফায়ল (রা.) বলেন-
كان أبيض مليح الوجه مرأة وكأن البدر يري في وجهه.
-রাসূল (সা.) ছিলেন শুভ্র এবং লাবন্যময় চেহারার অধিকারী। তিনি যখন আনন্দিত হতেন তখন তার চেহারায় যেন পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যেত। (মুসলিম)
হাবীবে খোদার জামাল-কামালের সরাসরি প্রত্যক্ষকারী সাহাবায়ে কেরাম তাদের কবিতায় নবীর সৌন্দর্যের অতুলনীয় বিবরণ দিয়েছেন।
নবীয় আকরাম (সা.)-এর সুন্দর্যের বর্ণনায় হযরত হাসসান বিন ছাবিত (রা.) বলেন-
أحسن منك لم تري قط عين + وأجمل منك لم تلد النساء
-আপনার চেয়ে সুন্দর কোন মানুষ আমার চোখ দেখেনি, আর আপনার চেয়ে অধিক সুন্দর শিশু কোন নারী জন্ম দেয়নি।
হযরত কা’ব বিন যুহায়র (রা.) বলেন-
إن الرسول لنور يستضاء به + مهند من سيوف الله مسلول
-নিশ্চয়ই রাসূল (সা.) হলেন নূর, তার থেকে সবি আলোকিত হয়। তিনি আল্লাহর ধারালো তরবারী।
হযরত হাসান ইবনু আলী (রা.) বলেন-
فخما مفخما يتلألأ وجهه صلي الله عليه وسلم تلألؤ القمر ليلة البدر
-রাসূল (সা.) ছিলেন সম্মান ও মর্যাদার আধাঁর, পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ন্যায় তার চেহারা থেকে নূর বিচ্ছূরিত হতো।
জনৈকা মহিলা নবীজীর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- তার চেহারা ছিল পূর্ণিমার রজনীর চাঁদের ন্যায়। আমি ইতোপূর্বে তার মতো কাউকে দেখিনি, পরেও দেখিনি। (তিরমিযী)
হযরত আয়শা (রা.) বলেন-
إذا سر تبرق أسارير وجهه كأنه قطعة قمر
রাসূল (সা.) যখন আনন্দিত হতেন তখন তার চেহারা অধিক উজ্জল হতো, দেখলে মনে হতো যেন নক্ষত্রের এক টুকরো।
নবীজীর সৌন্দর্যের বর্ণনায় উম্মে মা’বাদ (রা.) বলেন-
এসেছিলেন মোদের ঘরে এক মোবারক মেহমান
এসেছিলেন খিমায় মোদের রূপ জগতের রাজ কুমার
লাবণ্যময় স্বর্ণ উজাল মধ্য তনুকান্তি তাঁর
সতেজ সুঠাম শোভন দেহ প্রশস্ত স্কন্ধদ্বয়
যুক্ত ভুরু গ্রীবা দীঘল চওড়া ললাট জ্যোতির্ময়
সরল সোজা উচ্চনাতি টিকালো নাক মন মোহন
গোলাপ রাঙা অধর যুগল টশটশে বেশ সুদর্শন
মুন্ড সুগোল দর্শনীয় বিনয়নত উচ্চশির
চিত্তহারি কুসুম কোমল অঙ্গে সুবাস কস্তুরির।
(কাব্যানুবাদ: কবি রূহুল আমীন খান)

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা

মুফতী মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
কুরআন, সুন্নাহ এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সংঘটিত ইজমা ও কিয়াস-এ চারটি মূলনীতি হচ্ছে দীন ও শরীআতের যাবতীয় বিধি বিধানের মাপকাঠি। কিন্তু কুরআন সুন্নাহতে বর্ণিত আহকামসমূহের প্রত্যেকটি সমান নয়। কিছু কিছু আহকাম হচ্ছে স্পষ্ট ও বিরোধমুক্ত। যেমন নামায ফরয হওয়া, রোযা ফরয হওয়া, হজ্জ ফরয হওয়া, যিনা নিষিদ্ধ হওয়া, মদ খাওয়া ও চুরি করা নিষিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। এগুলোর উপর আমলের জন্য কোন প্রকার চিন্তা গবেষণার প্রয়োজন নেই।
পক্ষান্তরে কিছু কিছু আহকাম হচ্ছে এমন যে, এগুলো সম্পর্কে বর্ণিত আয়াত বা হাদীস অস্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত বা আপাত:দৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ। যেমন- আল্লাহ তা’আলার বাণী: وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ আলোচ্য আয়াতে قُرُوءٍ শব্দটি দুইটি অর্থে মুশতারাক। একটি হলো حيض (ঋতুস্রাব), অপরটি হলো طهر (পবিত্রতা)। সুতরাং এখানে শব্দটি কোন অর্থে গৃহীত হবে সে বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন আছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস:
مَنْ لم يترك المخابرة فليأذَن بِحَرب من الله ورسوله. (جامع الأصول في أحاديث الرسول)
অর্থাৎ যে মুখাবারা বা বর্গা ব্যবস্থা পরিহার করে না সে যেন আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধে নামার ঝুঁকি নেয়।
এ হাদীস থেকে আমভাবে বর্গা প্রথা নিষিদ্ধ বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু সকল বর্গাই নিষিদ্ধ নাকি এর বিশেষ কোন প্রকার নিষিদ্ধ তা এখানে সুস্পষ্ট নয়।
অন্য হাদীসে আছে-  مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ . (إتحاف الخيرة المهرة) অর্থাৎ যে ইমামের পেছনে নামায পড়বে, ইমামের কিরাত তার জন্য যথেষ্ট হবে। অপরদিকে অন্য হাদীসে এসেছে-
لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ. (إتحاف الخيرة المهرة)
অর্থাৎ যে সূরা ফাতিহা পড়েনি তার নামায শুদ্ধ হয়নি।
আলোচ্য হাদীসদ্বয় আপাতদৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ হওয়ায় কোন হাদীসের উপর আমল করা যাবে তা স্পষ্ট নয় এবং স্বাভাবিক ইলম দ্বারা তা বুঝাও সম্ভব নয়।
এ ধরণের জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে আমলের জন্য দুটি পথ। প্রথমত: নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করে ফয়সালা করা। দ্বিতীয়ত: এ ব্যাপারে পূর্বসূরীগণের প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের আলোকে আমল করা। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পথই সাধারণ মানুষ ও অমুজতাহিদ আলিমের জন্য অপরিহার্য। তা না হলে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর এরূপ মাসআলায় নির্দ্বিধায় কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করার নামই হচ্ছে তাকলীদ।
জটিল মাসআলায় সাধারণ লোকদের তাকলীদ ছাড়া কোন পথই নেই। তাদেরকে পূর্বসূরী প্রজ্ঞাশীল কোন মুজতাহিদকে অনুসরণ করতেই হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এরূপ তাকলীদের সরাসরি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কুরআন মজীদে তাকলীদের দলীল
১। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ .
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলুল আমর এর আনুগত্য কর। (সূরা নিসা- ৫৯)
উক্ত আয়াতেأُولِي الْأَمْرِ  বলতে কারা- এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কিরাম প্রায় সকলেই বলেছেন, এরা হলেন কুরআন সুন্নাহ’র ইলমের অধিকারী ফকীহ ও মুজতাহিদগণ।
২। পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে আছে-
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ .
অর্থাৎ যখন তাদের কাছে শান্তি অথবা ভীতি সংক্রান্ত কোন সংবাদ আসে, তখন তারা তা প্রচারে লেগে যায়। অথচ যদি (তারা তা না করে) বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর এর কাছে ছেড়ে দিত, তাহলে ইস্তিম্বাতে পারদর্শী তথা সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারীগণ এর রহস্য উদঘাটন করতে পারতেন। (সূরা নিসা- ৮৩)
উক্ত আয়াত যুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হলেও একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, পবিত্র কুরআনের কোন আয়াতের শানে নুযুল খাস হলেও এর উপর আমল আম। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন জটিল বিষয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে বিজ্ঞ লোকদের প্রজ্ঞাশীল সিদ্ধান্তের অনুসরণ ও তাকলীদ করা আবশ্যক।
৩। অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
Ñপ্রত্যেক দল থেকে এক একটি ছোট দল ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন বেরিয়ে পড়ে না, যাতে তারা যখন তাদের কওমের কাছে ফিরে আসবে তখন তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করবে, যেন তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবাহ- ১২২)
উক্ত আয়াতে ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য একদল লোককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর কওমের বাকী লোক যারা এ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভ করতে পারেনি তাদেরকে ঐ ফকীহদের আনুগত্য বা তাকলীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৪। আল্লাহ তাআলার বাণী- فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ অর্থাৎ তোমরা যদি না জান তাহলে আহলে ইলমদের কাছ থেকে জেনে নাও। (সূরা নহল- ৪৩, আম্বিয়া- ০৭)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ সকলকে কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি ফতওয়া বের করার নির্দেশ না দিয়ে বরং কুরআন হাদীসের ইলমে পারদর্শী লোকদের কাছ থেকে অজ্ঞ লোকদের জেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাকলীদের মূল কথাও হলো তাই।

হাদীস শরীফ থেকে তাকলীদের দলীল
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদীস থেকে অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞ আলিমের কাছে ফতওয়া তলব ও তদনুযায়ী আমল করার নির্দেশ ও প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
০১। হাদীস শরীফে আছে-
عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جُلُوسًا فَقَالَ إِنِّي لَا أَدْرِي مَا قَدْرُ بَقَائِي فِيكُمْ فَاقْتَدُوا بِالَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي وَأَشَارَ إِلَى أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ.
-হযরত হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- জানি না আমি আর কতদিন তোমাদের মধ্যে থাকব। সুতরাং তোমরা আমার পরবর্তীদের অনুসরণ করবে। একথা বলে তিনি আবূ বকর ও উমর (রা.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে ইমাম আহমদ)
উক্ত হাদীসে ‘ইকতিদা’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যার অর্থ শরীআতের বিষয়সমূহে কেউ কারো অনুসরণ করা।
০২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أُفْتِىَ بِغَيْرِ عِلْمٍ كَانَ إِثْمُهُ عَلَى مَنْ أَفْتَاهُ.
অর্থাৎ যে না জেনে ফতওয়া প্রদান করবে, এর পাপ ফতওয়াদাতার উপরই পতিত হবে।
লক্ষ্যণীয় যে, এখানে ফতওয়ার দায়-দায়িত্ব ফতওয়াদাতার উপর চাপানো হয়েছে। কিন্তু তার ফতওয়া অনুযায়ী যারা আমল করেছেন তাদেরকে দোষারোপ করা হয়নি। আবার অনুসরণকারীদেরকে যাচাই বাছাই করে ফতওয়া গ্রহণের নির্দেশও দেয়া হয়নি। এরূপ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফতওয়াদাতা ও আমলকারী উভয়কে সমানভাবে দোষারোপ করতেন। এতে বুঝা যায় একদল লোক কেবল তাকলীদ করবেন এবং তাদের তাকলীদ করা শুদ্ধ হবে।
০৩। কোন কোন সাহাবী নামাযের জামাতে দেরিতে এসে পেছনে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে প্রথমে এসে প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর তাকীদ দিয়ে ইরশাদ করেন-
ائْتَمُّوا بِي وَلْيَأْتَمَّ بِكُمْ مَنْ بَعْدَكُمْ
অর্থাৎ তোমরা আমার অনুসরণ কর আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদের অনুসরণ করবে।
[সূত্র : মুফতী মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী কৃত ‘তাকলীদের সুদৃঢ় রজ্জু’]

বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫

তাকলীদ ও আহলে হাদীস

মাহমুদুল হাসান
তাকলীদ এর আভিধানিক অর্থ গলায় হার পরানো শরীআতের পরিভাষায় তাকলীদ হলো নির্ভরযোগ্য আলিম এর মতামতকে সঠিক জেনে দলীল তলব না করে মানার নাম তাকলীদ
দলীল-প্রমাণ না চেয়ে আলিমের রায় মেনে নেওয়াই হলো তাকলীদসালাফে সালেহীন তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামোয়ে কিরাম যুগ যুগ ধরে আইম্মায়ে আরবাআ (ইমাম আবূ হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল) এর কোন কোন এক ইমামের তাকলীদ করে আসছেন এমনকি নব্যপ্রসূত লা-মাযহাবীরা হাদীসের ক্ষেত্রে যে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করে তিনিও তাকলীদে বিশ্বাস করতেন এবং মানতেনতার ছাত্র ইবনু কাইয়িম আল জাওযিয়্যাহও মাযহাব মানতেনইবনু তাইমিয়ার মাযহাব সম্পর্কে আহলে হাদীসদের অন্যতম আলেম সিদ্দিক হাসান তাঁর আল-জুন্নাহকিতাবের ৩৮ পৃষ্টায় বলেন- শায়খূল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেনতার ছাত্র ইবনু কাইয়িমও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন
ইবনু তাইমিয়া এবং ইবনু কাইয়িম আল জাওযিয়্যাহ এর মাযহাব হাম্বলী হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাইতাঁর লিখিত মাজমুআতুল ফাতাওয়াএর প্রমাণ বহন করে
প্রশ্ন হলো তাকলীদের ক্ষেত্রে কেন দলীল চাওয়ার প্রয়োজন নেই? সহজ উত্তর- আল্লাহ তাআলা দলীল চাইতে বলেন নি তাই চাওয়া যাবে নাতাকলীদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে- فاسئلوا اهل الذكر إن كنتم لا تعلمون
অর্থ্যা- তোমরা যদি কোন বিষয়ে না জান তাহলে যারা জানে তাদের কাছে জেনে নাও
এই আয়াতে মহান আল্লাহ অজানা বিষয় জানার জন্য বলেছেন, তার জন্য দলীল বা প্রমাণ চাইতে বলেন নিপবিত্র হাদীস শরীফে আমরা উক্ত আয়াতের বাস্তব চিত্র খুজে পাইসাহাবায়ে কিরাম কোন অজানা বিষয়ে যিনি জানেন তাকে প্রশ্ন করলে তিনি যা বলতেন তাই মেনে নিতেনএর জন্য দলীল চাইতেন না
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) কে একবার দুই ব্যাক্তির ঋণ সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলো যে, প্রথমজন দ্বিতীয়জনের কাছে মেয়াদী ঋণের পাওনাদারমেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে ঋণ পরিশোধ করলে আংশিক ঋণ মওকূফে সম্মত হয়েছেএ ব্যাপারে শরীআতের নির্দেশ কি? হযতে উমর (রা.) তা নাকচ করে দিলেন
হযরত উমর (রা.) নিজ ইজতিহাদ থেকে এই মাসআলা দিয়েছেনসে জন্যে তিনি দলীল পেশ করারও প্রয়োজনবোধ করেননি, এমনকি প্রশ্ন কর্তাও দলীল জানতে চান নি বিনা দলীলে মেনে নিয়েছেনআর বিনা দলীলে মেনে নেওয়ার নামই হলো তাকলীদ
ফারায়যের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসআলা সম্পর্কে হযরত আলী (রা.) কে প্রশ্ন করা হলোতখন তিনি মিম্বরের উপর ছিলেনআলী (রা.) মিম্বরে বসে ফতওয়া দিলেন; তিনি কোন দলীল পেশ করেন নিপ্রশ্নকর্তাও ফতওয়ার পক্ষে কোন দলীল তলব করেননি
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে- জনৈক মহিলা সাহাবী রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে আরজ করলেন-ইয়া রাসূল্লাহ! আমার স্বামী জিহাদে গমন করেছেনতিনি থাকাবস্থায় আমি নামাযসহ অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করতামতিনি ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে এমন আমল শিখিয়ে দিন যা তার আমলের স্থলাভিষিক্ত হয়
দেখুন! মহিলা সাহাবী তার যাবতীয় আমলের ক্ষেত্রে তার স্বামীর ইকতিদা করেছেনরাসূল (সা.)ও তা সমর্থন করেছেন
শরীআত সকল মুসলমানদের উপর ফতওয়া প্রদানের দায়িত্ব দেয়নিএকমাত্র কুরআন-হাদীসে পারদর্শীগণ মাসআলা ইস্তিন্ব^াত করবেন, ফতওয়া দিবেনসাধারণ মুসলমান দলীল না চেয়ে তাদের কথা মেনে নিবেনএ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا في الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থা- দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রত্যেক দল থেকে একটি উপদল কেন বেরিয়ে পড়ে না, যেন ফিরে এসে ম্বজাতিকে তারা সতর্ক করতে পারে?
এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের কিছু অংশকে দ্বীনী শিক্ষায় পান্ডিত্য অর্জনের কথা বলেছেনযারা শিক্ষা অর্জন করে অবশিষ্ঠ্য মুসলমান; যারা দ্বীনী শিক্ষায় পান্ডিত্য অর্জন করেনি তথা সাধারণ মুসলমানদেরকে নসীহত করবে এবং সাধারণ মুসলমান তাদের কথা মেনে চলবে
মহান আল্লাহ মুসলমানদের সার্বিক সুবিধার জন্যে এই নির্দেশ দিয়েছেনকারণ দ্বীনী বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়পক্ষান্তরে আহলে হাদীসরা মহান আল্লাহর এই সহজ বিধানকে কঠিন থেকে কঠিনতর করার জন্যে বলে যে সকল মুসলমানের জন্য কুরআন-হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতে হবে
ইসলামের সকল যুগেই দুধরনের মুসলমান ছিলেনআম এবং খাসমুসলমানদের এক অংশ দ্বীনী বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখতেন, ইজতিহাদ করতেন এবং সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেনআর অপর পক্ষ তাদের কথা মেনে নিয়ে আমল করতেনযেমন
হযরত আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রা.) বিশেষ একপ্রকার মোজা পরতে দেখে উমর (রা.) বলেছিলেন- তোমাকে কসম দিয়ে বলছি তুমি মোজা জোড়া খুলে ফেলকারণ আমি আশঙ্কা করি সাধারণ লোকজন তোমাকে দেখে তোমার ইকতিদা করবে
হযতে তালহা (রা.) এর গায়ে রঙ্গিন ইহরাম দেখে হযরত উমর (রা.) বললেন এটা কেন পড়েছে? তালহা (রা.) বললেন এটাতে তো সুগন্ধি নাইউমর (রা.) বললেন- শুন! তোমরা হলে ইমামসাধারণ লোকজন তোমাদের ইকতদা করেকোন অজ্ঞ লোক তোমার এই কাপড় দেখলে বলবে তালহা ইবনু উবায়দুল্লাহ ইহােম হিসাবে রঙ্গিন কাপড় পড়তেন (না বুঝে সুগন্ধযুক্ত এবং সুগন্ধহীন উভয় কাপড় পড়া শুরু করবে)সুতরায় তোমরা এমন কাপড় পড়ো না
ইসলামের প্রতিটি যুগে সাধারণ মুসলমানদের বিরাট একটি অংশ ছিলযারা উলামায়ে কেরামের কথা, উক্তি এবং তাদের দেখানো আমল আদর্শ হিসাবে মানতেন এবং তাকলীদ বা অনুসরণ করতেনকারণ তারা বিশ্বাস করতেন উলামায়ে কিরাম যে ফতওয়া বা আদর্শ আমাদেরকে দিচ্ছেন সেটা অবশ্যই কুরআন এবং হাদীস গবেষণা করেই দিচ্ছেনএই গবেষনার নাম হচ্ছে ইজতিহাদ
আহলে হাদীসরা মুসলমানদেরকে তাদের পূর্বসুরীদের পথ এবং মত থেকে সরিয়ে দাজ্জালী ফিতনার মুখোমুখি করার প্রয়াস চালাচ্ছেতারা সরলমনা মুসলমানদের ধোকা দেওয়ার জন্য বলে পূর্বসুরীদের পথ আকড়ে ধরা হলো কাফিরদের স্বভাবঅথচ কুরআন শরীফে আল্লাহ তালা মুনাফিকদের বৈশিষ্ঠ সম্পর্কে বলেন আর তারা মুমিনদের (রেখে যাওয়া) পথ ছেড়ে অন্য পথের অনুসরণ করে
লা-মাযহাবীরা মুখে যতই বলুক যে তারা তাকলীদ করে না কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিটি কাজ-কর্মই তাকলীদ অনুযায়ী হচ্ছেযেমন, আমরা জানি কুরআন শরীফ সাত কিরাআতে নাযিল হয়েছে বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত প্রচলিত আছেবিশ্বের সকল মুসলমান এ ক্ষেত্রে ইমাম হাফস (র.)-এর তাকলীদ করেনআহলে হাদীস, লা-মাযহাবী, সালাফীরাও ইমাম হাফসের কিরাআতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেন; এত তারা ইমাম হাফস (র.)-এর তাকলীদ করল

আহলে হাদীসের প্রতি কিছু প্রশ্ন
আহলে হাদীসরা মাযহাব পন্থী লোকদের ধোকা দেওয়ার জন্য দসব সময় বলে থাকেন কুরআন এবং সহীহ হাদীসে আছে কি না? সে জন্যে নিচে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হলো, আহলে হাদীস ভাইগণ উত্তর দিবেন
নামাযসহ শরীআতের বিভিন্ন হুকুম-আহকামে যে সমস্ত ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাব ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে সেগুলো প্রমাণ করুন
হাদীস শরীফে মানুষের ছবির ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা এসেছেতারপরও আহলে হাদীস ভাইয়েরা টি.ভি তে অনুষ্ঠান করেন কোন আয়াত এবং সহীহ হাদীসের আলোকে?
পবিত্র হাদীস অনুযায়ী ছবি তোলা হারামতাহলে হজ্জের জন্য ছবি তুলা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণ পেশ করুন
পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) কোন কিরাত পড়তেন? ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত রাসূল (সা.)-এর কিরাত কি না? সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণ করুনযদি না হয় তাহলে আপনারা রাসূল (সা.) এর কিরাতে পড়েন না কেন?
মোবাইলে বা রেকর্ডে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা ওয়াজিব হবে কি না? কুরআন এবং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করুন

রাসূল (সা.)-এর যুগে হাদীস সংকলিত হয়েছিল কি না? সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ দিন