মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০১৫

আল কুরআন : দ্যা চ্যালেঞ্জার


মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ পাক যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর যুগের চাহিদা অনুসারে তাঁদেরকে দিয়েছেন আসমানীগ্রন্থ। স্বভাবতই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাযিল হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কুরআন। বিষয় বৈচিত্র, স্বকীয়তা, অনুপম রচনাশৈলী, প্রকাশ ভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য, সহজ ও সুন্দর ও সাবলীল বাক্য বিন্যাস, অকাট্য যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন ইত্যাদি দিক বিবেচনায় আল কুরআন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্দেহাতীত গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আয়াতসমূহ সুদীর্ঘ তেইশ বছরে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই মহানবী (সা.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। এতে বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব ও সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে, নানাবিধ সন্দেহের অপনোদন করা হয়েছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব যুক্তি প্রমাণ খন্ডন করার জন্য খোদাদ্রোহীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বিশেষতঃ আল কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতারিত কি না? এটি সত্য সত্যই আসমানী গ্রন্থ কি না? ইত্যকার বিষয়ে যারা সন্দেহ পোষণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন। আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (র.)-এর ‘আল ইতক্বান’ এর ভাষ্য মতে প্রথমতঃ তাদেরকে সমস্ত কুরআন মজিদের অনুরূপ গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِثْلِهِ إِنْ كَانُوا صَادِقِينَ -
“যদি তারা দাবীতে সত্যবাদী হয় তবে যেন কুরআনের অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনা করে নিয়ে  আসে” (সূরা তূর, আয়াত-৩৪)।
এ চ্যালেঞ্জের পর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কয়েক বছর সময় দেন, কিন্তু তারা কুরআনের সমকক্ষ কিছু রচনা করতে সক্ষম হয় নি। এরপর তাদেরকে কুরআন মজীদের অনুরূপ দশটি সূরা রচনার চ্যালেঞ্জ করা হয়। এ চ্যালেঞ্জ স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন ঃ-
أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ -
“তারা কি বলে তিনি [মুহাম্মদ সা.] এ কিতাব রচনা করেছেন? হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা রচনা কর এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও” (সূরা হুদ-১৩)।
অতঃপর কুরআনের অনুরূপ কেবল একটি সূরা রচনার চ্যালেঞ্জ করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন ঃ-
أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ -
“তারা কি বলে তিনি [মুহাম্মদ সা.] এ কিতাব রচনা করেছেন? হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা রচনা কর এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও’ (সূরা ইউনুস-৩৮)।
এ পর্যায়ে আল্লাহ আবারও ঘোষণা দেন ঃ
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ - فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ -
“আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি তাতে যদি তোমরা সন্দেহ কর, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা রচনা কর এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্য সাহায্যকারীদের ডেকে নাও” (সূরা বাক্বারা-২৩-২৪)।
মক্কার কাফিরগোষ্ঠী সে চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় অক্ষম হয়ে পড়ে। যে কাফির কবি-সাহিত্যিক গোষ্ঠী মন মাতানো ছন্দ-ঝংকারে সারা আরব জাহান মোহিত ও প্রভাবান্বিত করে রাখত তারা পবিত্র কুরআনের একটি সূরারও মুকাবিলা তো দূরের কথা, বরং এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। আরবের খ্যাতনামা কবি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা এতই দাম্ভিক ছিল যে, সে অন্য কাউকে নিজের সমকক্ষ মনে করত না। কুরায়শগণ তাকে অঢেল ধন-সম্পদ ও সম্মানের লোভ দেখিয়ে কুরআনের মত একটি আয়াত রচনা করতে পীড়াপীড়ি শুরু করল। সে বলল, হে কুরায়শগণ! তোমরা তাকে যাদুকর বলছ, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি যাদুকর নন। আমি যাদুর তন্ত্রমন্ত্র দেখেছি। তোমরা তাঁকে পাগল বলছ, আল্লাহর শপথ! তিনি পাগল নন, আমি পাগল ও তাদের কার্যকলাপ দেখেছি। হে কুরায়শগণ, তোমরা নিজেদের অবস্থা চিন্তা কর। আল্লাহর শপথ! পবিত্র কুরআন নিশ্চয় অমূল্য সম্পদ এবং তা আমাদের জন্য নাযিল করা হয়েছে।
লবিদ ইবনে রবীয়া ছিলেন তৎকালীন আরব কবিদের শিরমণি। কবিতা রচনায় অসাধারণ দক্ষ বলে তিনি অপরাপর সাহিত্যিকদের ঘৃণার চোখে দেখতেন। কিন্তু কুরআনের আয়াতের মুকাবিলায় তিনিও অক্ষম হয়ে পড়েন। যখন কুরআন মজীদের একটি সূরা কা’বা ঘরে টাঙ্গানো হলো, তখন তিনি এটি পড়ে অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। একই সাথে তার মনে হলো এটি কোন মানব রচিত পংক্তি নয়, বরং ইহা  আল্লাহর কালাম। তাই তিনি অকপটে ঘোষণা করলেন, ليس هذا من كلام البشر পরিশেষে তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন।
এমনিভাবে ওলীদ ইবনে মুগীরা, লবিদ ইবনে রবিয়ার মত অন্য সকল আরব কবি আল কুরআনের চ্যালেঞ্জ-এর কাছে নতি স্বীকার করেছে, এর মুকাবিলায় তারা অক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে স্বকীয়তা ও সত্যতার চ্যালেঞ্জার হিসেবে আল কুরআন আপন মহিমায় শ্রেষ্ঠত্ব ও বিজয়ের আসনে সমাসীন থেকেছে। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন-
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا -
- [হে মুহাম্মদ (সা.)!] আপনি বলে দিন, যদি কুরআন অনুরূপ রচনা করার জন্য মানুষ ও জিন জাতি সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না (বনী ইসরাঈল, আয়াত-৮৮)।
আল কুরআনুল কারীম মহান আল্লাহর বাণী। এটি চিরন্তন ও চিরশাশ্বত। কোন কালে কাফির-মুশরিকগোষ্ঠী এর মুকাবিলা করতে পারে নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত কখনো পারবে না। চিরকাল অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহাগ্রন্থ হিসেবে এটি টিকে থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন