বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫

তাকলীদ ও আহলে হাদীস

মাহমুদুল হাসান
তাকলীদ এর আভিধানিক অর্থ গলায় হার পরানো শরীআতের পরিভাষায় তাকলীদ হলো নির্ভরযোগ্য আলিম এর মতামতকে সঠিক জেনে দলীল তলব না করে মানার নাম তাকলীদ
দলীল-প্রমাণ না চেয়ে আলিমের রায় মেনে নেওয়াই হলো তাকলীদসালাফে সালেহীন তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামোয়ে কিরাম যুগ যুগ ধরে আইম্মায়ে আরবাআ (ইমাম আবূ হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল) এর কোন কোন এক ইমামের তাকলীদ করে আসছেন এমনকি নব্যপ্রসূত লা-মাযহাবীরা হাদীসের ক্ষেত্রে যে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করে তিনিও তাকলীদে বিশ্বাস করতেন এবং মানতেনতার ছাত্র ইবনু কাইয়িম আল জাওযিয়্যাহও মাযহাব মানতেনইবনু তাইমিয়ার মাযহাব সম্পর্কে আহলে হাদীসদের অন্যতম আলেম সিদ্দিক হাসান তাঁর আল-জুন্নাহকিতাবের ৩৮ পৃষ্টায় বলেন- শায়খূল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেনতার ছাত্র ইবনু কাইয়িমও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন
ইবনু তাইমিয়া এবং ইবনু কাইয়িম আল জাওযিয়্যাহ এর মাযহাব হাম্বলী হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাইতাঁর লিখিত মাজমুআতুল ফাতাওয়াএর প্রমাণ বহন করে
প্রশ্ন হলো তাকলীদের ক্ষেত্রে কেন দলীল চাওয়ার প্রয়োজন নেই? সহজ উত্তর- আল্লাহ তাআলা দলীল চাইতে বলেন নি তাই চাওয়া যাবে নাতাকলীদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে- فاسئلوا اهل الذكر إن كنتم لا تعلمون
অর্থ্যা- তোমরা যদি কোন বিষয়ে না জান তাহলে যারা জানে তাদের কাছে জেনে নাও
এই আয়াতে মহান আল্লাহ অজানা বিষয় জানার জন্য বলেছেন, তার জন্য দলীল বা প্রমাণ চাইতে বলেন নিপবিত্র হাদীস শরীফে আমরা উক্ত আয়াতের বাস্তব চিত্র খুজে পাইসাহাবায়ে কিরাম কোন অজানা বিষয়ে যিনি জানেন তাকে প্রশ্ন করলে তিনি যা বলতেন তাই মেনে নিতেনএর জন্য দলীল চাইতেন না
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) কে একবার দুই ব্যাক্তির ঋণ সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলো যে, প্রথমজন দ্বিতীয়জনের কাছে মেয়াদী ঋণের পাওনাদারমেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে ঋণ পরিশোধ করলে আংশিক ঋণ মওকূফে সম্মত হয়েছেএ ব্যাপারে শরীআতের নির্দেশ কি? হযতে উমর (রা.) তা নাকচ করে দিলেন
হযরত উমর (রা.) নিজ ইজতিহাদ থেকে এই মাসআলা দিয়েছেনসে জন্যে তিনি দলীল পেশ করারও প্রয়োজনবোধ করেননি, এমনকি প্রশ্ন কর্তাও দলীল জানতে চান নি বিনা দলীলে মেনে নিয়েছেনআর বিনা দলীলে মেনে নেওয়ার নামই হলো তাকলীদ
ফারায়যের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসআলা সম্পর্কে হযরত আলী (রা.) কে প্রশ্ন করা হলোতখন তিনি মিম্বরের উপর ছিলেনআলী (রা.) মিম্বরে বসে ফতওয়া দিলেন; তিনি কোন দলীল পেশ করেন নিপ্রশ্নকর্তাও ফতওয়ার পক্ষে কোন দলীল তলব করেননি
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে- জনৈক মহিলা সাহাবী রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে আরজ করলেন-ইয়া রাসূল্লাহ! আমার স্বামী জিহাদে গমন করেছেনতিনি থাকাবস্থায় আমি নামাযসহ অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করতামতিনি ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে এমন আমল শিখিয়ে দিন যা তার আমলের স্থলাভিষিক্ত হয়
দেখুন! মহিলা সাহাবী তার যাবতীয় আমলের ক্ষেত্রে তার স্বামীর ইকতিদা করেছেনরাসূল (সা.)ও তা সমর্থন করেছেন
শরীআত সকল মুসলমানদের উপর ফতওয়া প্রদানের দায়িত্ব দেয়নিএকমাত্র কুরআন-হাদীসে পারদর্শীগণ মাসআলা ইস্তিন্ব^াত করবেন, ফতওয়া দিবেনসাধারণ মুসলমান দলীল না চেয়ে তাদের কথা মেনে নিবেনএ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا في الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থা- দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রত্যেক দল থেকে একটি উপদল কেন বেরিয়ে পড়ে না, যেন ফিরে এসে ম্বজাতিকে তারা সতর্ক করতে পারে?
এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের কিছু অংশকে দ্বীনী শিক্ষায় পান্ডিত্য অর্জনের কথা বলেছেনযারা শিক্ষা অর্জন করে অবশিষ্ঠ্য মুসলমান; যারা দ্বীনী শিক্ষায় পান্ডিত্য অর্জন করেনি তথা সাধারণ মুসলমানদেরকে নসীহত করবে এবং সাধারণ মুসলমান তাদের কথা মেনে চলবে
মহান আল্লাহ মুসলমানদের সার্বিক সুবিধার জন্যে এই নির্দেশ দিয়েছেনকারণ দ্বীনী বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়পক্ষান্তরে আহলে হাদীসরা মহান আল্লাহর এই সহজ বিধানকে কঠিন থেকে কঠিনতর করার জন্যে বলে যে সকল মুসলমানের জন্য কুরআন-হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতে হবে
ইসলামের সকল যুগেই দুধরনের মুসলমান ছিলেনআম এবং খাসমুসলমানদের এক অংশ দ্বীনী বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখতেন, ইজতিহাদ করতেন এবং সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেনআর অপর পক্ষ তাদের কথা মেনে নিয়ে আমল করতেনযেমন
হযরত আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রা.) বিশেষ একপ্রকার মোজা পরতে দেখে উমর (রা.) বলেছিলেন- তোমাকে কসম দিয়ে বলছি তুমি মোজা জোড়া খুলে ফেলকারণ আমি আশঙ্কা করি সাধারণ লোকজন তোমাকে দেখে তোমার ইকতিদা করবে
হযতে তালহা (রা.) এর গায়ে রঙ্গিন ইহরাম দেখে হযরত উমর (রা.) বললেন এটা কেন পড়েছে? তালহা (রা.) বললেন এটাতে তো সুগন্ধি নাইউমর (রা.) বললেন- শুন! তোমরা হলে ইমামসাধারণ লোকজন তোমাদের ইকতদা করেকোন অজ্ঞ লোক তোমার এই কাপড় দেখলে বলবে তালহা ইবনু উবায়দুল্লাহ ইহােম হিসাবে রঙ্গিন কাপড় পড়তেন (না বুঝে সুগন্ধযুক্ত এবং সুগন্ধহীন উভয় কাপড় পড়া শুরু করবে)সুতরায় তোমরা এমন কাপড় পড়ো না
ইসলামের প্রতিটি যুগে সাধারণ মুসলমানদের বিরাট একটি অংশ ছিলযারা উলামায়ে কেরামের কথা, উক্তি এবং তাদের দেখানো আমল আদর্শ হিসাবে মানতেন এবং তাকলীদ বা অনুসরণ করতেনকারণ তারা বিশ্বাস করতেন উলামায়ে কিরাম যে ফতওয়া বা আদর্শ আমাদেরকে দিচ্ছেন সেটা অবশ্যই কুরআন এবং হাদীস গবেষণা করেই দিচ্ছেনএই গবেষনার নাম হচ্ছে ইজতিহাদ
আহলে হাদীসরা মুসলমানদেরকে তাদের পূর্বসুরীদের পথ এবং মত থেকে সরিয়ে দাজ্জালী ফিতনার মুখোমুখি করার প্রয়াস চালাচ্ছেতারা সরলমনা মুসলমানদের ধোকা দেওয়ার জন্য বলে পূর্বসুরীদের পথ আকড়ে ধরা হলো কাফিরদের স্বভাবঅথচ কুরআন শরীফে আল্লাহ তালা মুনাফিকদের বৈশিষ্ঠ সম্পর্কে বলেন আর তারা মুমিনদের (রেখে যাওয়া) পথ ছেড়ে অন্য পথের অনুসরণ করে
লা-মাযহাবীরা মুখে যতই বলুক যে তারা তাকলীদ করে না কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিটি কাজ-কর্মই তাকলীদ অনুযায়ী হচ্ছেযেমন, আমরা জানি কুরআন শরীফ সাত কিরাআতে নাযিল হয়েছে বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত প্রচলিত আছেবিশ্বের সকল মুসলমান এ ক্ষেত্রে ইমাম হাফস (র.)-এর তাকলীদ করেনআহলে হাদীস, লা-মাযহাবী, সালাফীরাও ইমাম হাফসের কিরাআতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেন; এত তারা ইমাম হাফস (র.)-এর তাকলীদ করল

আহলে হাদীসের প্রতি কিছু প্রশ্ন
আহলে হাদীসরা মাযহাব পন্থী লোকদের ধোকা দেওয়ার জন্য দসব সময় বলে থাকেন কুরআন এবং সহীহ হাদীসে আছে কি না? সে জন্যে নিচে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হলো, আহলে হাদীস ভাইগণ উত্তর দিবেন
নামাযসহ শরীআতের বিভিন্ন হুকুম-আহকামে যে সমস্ত ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাব ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে সেগুলো প্রমাণ করুন
হাদীস শরীফে মানুষের ছবির ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা এসেছেতারপরও আহলে হাদীস ভাইয়েরা টি.ভি তে অনুষ্ঠান করেন কোন আয়াত এবং সহীহ হাদীসের আলোকে?
পবিত্র হাদীস অনুযায়ী ছবি তোলা হারামতাহলে হজ্জের জন্য ছবি তুলা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণ পেশ করুন
পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) কোন কিরাত পড়তেন? ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত রাসূল (সা.)-এর কিরাত কি না? সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণ করুনযদি না হয় তাহলে আপনারা রাসূল (সা.) এর কিরাতে পড়েন না কেন?
মোবাইলে বা রেকর্ডে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা ওয়াজিব হবে কি না? কুরআন এবং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করুন

রাসূল (সা.)-এর যুগে হাদীস সংকলিত হয়েছিল কি না? সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ দিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন