সোমবার, ২ মার্চ, ২০১৫

প্রসঙ্গ : আউলিয়ায়ে কিরাম

মূল : হযরত আল্লামা ওয়াজিহ উদ্দীন রামপুরী (র.)
অনুবাদ : মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

ওলীর পরিচয়
‘আউলিয়া’ শব্দটি ‘ওলী’ শব্দের বহুবচন। ওলী ঐ মুমিন ব্যক্তিকে বলা হয় যিনি কবীরাহ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকেন এবং আহকামে এলাহী তথা খোদায়ী বিধি-বিধানকে যথাসাধ্য মেনে চলেন, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মত্ত হন না। অধিক ইবাদত ও রিয়াযতের ফলে তাঁর মধ্যে রূহানী লাতাফাত সৃষ্টি হয়। ফলে তাঁর ‘রু’য়া সালিহা’ বা উত্তম স্বপ্নের মতো সম্পদ হাসিল হয় অথবা তাঁর বিষয়ে অন্যরা উত্তম স্বপ্ন দেখেন। তাঁর সাহচর্য-সান্নিধ্য মানুষকে আল্লাহর স্মরণে নিবিষ্ট করে দেয়।

মরতবায়ে সিদ্দীকিয়াত
(ওলায়তের একটি স্তরে) ওলীর রূহ বা আত্মা নবীর রূহের সাথে এ পরিমাণ সম্পর্কিত হয় যে, এ স্তরে একজন ওলীর রূহ এমন সব বিষয় চিন্তা ভাবনা ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয় যা মূলত নবীর সত্তার জ্ঞান। এ স্তর ওলায়তের সকল স্তরের চেয়ে উত্তম ও সর্বোন্নত। এ স্তরের ওলীকে শরীআতের পরিভাষায় ‘সিদ্দীক’ বলা হয়। উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে অনেক সিদ্দীক অতিবাহিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মর্যাবান হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)। এ কারণে তাঁকে ‘সিদ্দীকে আকবর’ বলা হয়।
[নবীর কথা শুনার পর এ স্তরের ওলীর অন্তরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও আকলী দলীল-প্রমাণ তলবের খেয়ালও আসে না। যেমন, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ বকর (রা.)-এর সামনে ইসলামের কথা পেশ করলেন এবং বললেন : হে আবূ বকর, আমি আল্লাহর নবী ও রাসূল, তখন সিদ্দীকে আকবর (রা.) কোনো চিন্তা ছাড়াই তৎক্ষণাৎ তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য নবী ও শেষ যামানার রাসূল হিসেবে স্বীকার করে নিলেন এবং কলিমায়ে তায়্যিবা পড়ে ইসলামের মধ্যে দাখিল হয়ে ‘সিদ্দীকে আকবর’ উপাধিতে ভূষিত হলেন। এ কারণেই হযরত আবূ বকর (রা.) ‘নবীগণের পর সর্বোত্তম মানুষ’। এছাড়াও আরো বহু কারণ রয়েছে যার ভিত্তিতে আবূ বকর (রা.) ‘সিদ্দীকে আকবর’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।]
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কিছু নারীকেও এ মর্যাদা প্রদত্ত হয়েছে। কুরআনে আযীমে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর সম্মানিত মাতা হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : وامه صديقة ‘আর তাঁর (ঈসা আলাইহিস সালাম-এর) মা হলেন সিদ্দীকা।’

রুতবায়ে শাহাদত
সিদ্দীকিয়াতের নি¤œস্তর হলো রুতবায়ে শাহাদত। সুপ্রসিদ্ধ সংজ্ঞা মতে, শহীদ ঐ ব্যক্তি যিনি এ’লায়ে কালিমাতিল্লাহ তথা আল্লাহর কলিমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবন দান করেন। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.), কোনো ব্যক্তি সম্পদের জন্য লড়াই করে আবার কোনো ব্যক্তি মান-সম্মানের জন্য লড়াই করে, এদের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় কর্মসম্পাদনকারী কোন্ ব্যক্তি ?’ সরওয়ারে কায়িনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন :
من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا فهو في سبيل الله
-‘যে ব্যক্তি এই উদ্দেশ্যে জিহাদ করে যে আল্লাহর কলিমা বুলন্দ হবে সে ব্যক্তি আল্লাহর আল্লাহর রাস্তায় লড়াইকারী।’
অন্য হাদীসে আছে, সায়্যিদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, ‘হে সাহাবীগণ, তোমরা শহীদ বলতে কাকে বুঝ ?’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.) , যারা যুদ্ধে মারা যায়।’ আরব ও আজমের সরদার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমালেন, এ হিসেবে তো আমার উম্মতের সংখ্যা কম হয়ে যাবে, যাদের শহীদ বলা যাবে।
‘বরং যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাবে সে শহীদ, কোনো কিছুতে পিষ্ট হয়ে মারা গেলে শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করলেও শহীদ, তাউন তথা প্লেগরোগে মারা গেলেও শহীদ, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও শহীদ, সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণকারী মহিলাও শহীদ, নিউমোনিয়া রোগে মারা গেলেও শহীদ।’
অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, ‘যে নিজের দীন রক্ষার জন্য মৃত্যুবরণ করে সে শহীদ, যে সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষার জন্য মারা যায় সে শহীদ, যে আপন জীবন রক্ষার জন্য মারা যায় সে শহীদ।’
একদা হযূর রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ পাহাড়ের উপর আরোহন করেছিলেন আর তাঁর সাথে হযরত সিদ্দীকে আকবর, ফারূকে আ’যম ও ওসমান যিন্নুরাইন (রা.) ছিলেন। এ সময় পাহাড়ে কম্পন শুরু হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ পাহাড়ের উপর পদাঘাত করলেন আর বললেন : ‘ওহুদ, তুমি স্থির ও শান্ত থাকো, তোমার উপর এক নবী, এক সিদ্দীক ও দুই শহীদ রয়েছেন।’
এখানে নবী দ্বারা হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরানী সত্তা উদ্দেশ্য, সিদ্দীক দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) উদ্দেশ্য। আর দুই শহীদ দ্বারা হযরত ফারূকে আ’যম ওমর ইবনুল খাত্তাব ও হযরত ওসমান যিন্নুরাইন (রা.) উদ্দেশ্য। অথচ তখনো তাঁরা শহীদ হননি।
এ সকল হাদীসে মুবারাকার প্রতি লক্ষ্য রেখে হযরত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)  তদীয় তাফসীর ‘ফতহুল আযীয’-এর মধ্যে লিখেছেন, শহীদ ঐ মুমিন ব্যক্তি যে সর্বদা তার শির হাতের তালুতে নিয়ে চলাফেরা করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে জীবন বিলিয়ে দিতে কোনো দ্বিধা করে না।
وبال دوش ہے اس ناتواں پہ سر لیکن
لگا رکھا ترے حنجروسنان کے لئے
এ মরতবা উক্ত ব্যক্তিরই অর্জিত হয় যে আপন দৃষ্টিতে দুনিয়াকে তুচ্ছ এবং আখিরাতকে অবশ্যম্ভাবী মনে করতে পেরেছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির মুকাবিলায় সে নিজের জান, মাল, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজনের কোনো প্রয়োজন উপলব্ধি করে না। সাধারণত সাহাবায়ে ইযাম (রা.) এবং আল্লাহর বিশেষ ও নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাগণের এ অবস্থা ছিল।
دولت وشوکت وثروت سے گذر جاتے تھے
وقت جب آتاتھا اسلام پہ مر جاتے تھے

সারকথা, শহীদগণের পবিত্র রূহ সিদ্দীকগণের রূহের নিকটবর্তী। কিন্তু রূহে নবুওয়াতের সাথে তার সেরূপ সম্পর্ক লাভ হয় না, যেরূপ সিদ্দীকের হয়ে থাকে।

মরতবায়ে সালিহিয়্যাত
শাহাদতের নিচের স্তর হলো মরতবায়ে সালিহিয়্যাত। সালিহ বা সৎকর্মশীল হলেন ঐ বুযুর্গ, যিনি আহকামে এলাহী তথা খোদায়ী বিধি-বিধানের পাবন্দী করেন, কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকেন কিন্তু তাঁর রূহের ঐ স্তর হাসিল হয় না যা সিদ্দীক ও শহীদের হাসিল হয়। উলামায়ে কিরাম ও সূফীয়ায়ে ইযাম ওলীদের এ স্তরবিন্যাস কুরআনে আযীমের নি¤েœাক্ত আয়াত থেকে নিয়েছেন। আয়াতটি হলো :
وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا-
-‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে তারা তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের আল্লাহ তাআলা নিয়ামত দান করেছেন, তাঁরা হলেন নবী, শহীদ ও সালিহগণ, আর তাঁরা কতইনা উত্তম সঙ্গী।’
উক্ত আয়াতে ওলায়তের স্তর যেরূপ সাব্যস্ত আছে সে আলোকে তাঁদের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়।
এখানে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, আল্লাহর বিশেষ বান্দাগণের সঙ্গে থাকা এক বড় নিয়ামত। আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণের মধ্যেই যার ভিত্তি। আল্লাহর নৈকট্য, যার প্রত্যাশা প্রত্যেক দীনদারের অন্তরে রয়েছে, তা অর্জনের সর্বোত্তম ও সঠিক পথ হলো, উক্ত চার দলের মধ্যকার কোনো এক দলের সঙ্গী হওয়া। কেননা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছার জন্য সফরের সঙ্গী বা গাইড দরকার। আরবী একটি প্রবাদ আছে,  الرفيق ثم الطريقআগে সঙ্গী খোঁজ, পরে রাস্তায় (সফরে) বের হও।
ہیچ چیز خود بخود چیزے نشد
ہیچ آہن خود بخود تیغے نشد
مولوی ہرگز نشد مولائے روم
تا غلام شمس تبریزے نشد
-কোনো বস্তু নিজে নিজে  বস্তুতে পরিণত হয় না
কোনো লোহা নিজে নিজে তলোয়ার হয় না
মৌলভী কখনো মাওলায়ে রূম হয় না
যতক্ষণ না শামসে তাবরীযীর গোলাম হয়।

যাই হোক, এখানে ওলীর পরিচয় ও স্তর আলোচনা করা উদ্দেশ্য। ওলায়ত দুই প্রকার। যথা :
১. ওলায়তে সুগরা
২. ওলায়তে কুবরা।
ওলায়তে সুগরা
‘নাফহাতুল উন্স’ গ্রন্থে আলিমে রাব্বানী, আরিফে কামিল হযরত মাওলানা আবদুর রাহমান জামী (র.) বর্ণনা করেছেন যে, ওলায়ত দুই প্রকার। এক প্রকার হলো ওলায়তে সুগরা, যা ঈমান আনয়নের মাধ্যমে অর্জিত হয়। কুরআনে আযীমে আছে :
الله وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ-
-‘আল্লাহ তাআলা হলেন মুমিনগণের বন্ধু। তিনি তাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।’

ওলায়তে কুবরা
দ্বিতীয় প্রকার ওলায়ত হলো ওলায়তে কুবরা, যা বিশেষ বান্দাগণকে প্রদান করা হয়। তাকওয়া, পবিত্রতা, ইবাদত, রিয়াযত, মুজাহাদার সাথে সাথে এ স্তরের বান্দাগণের রূহানী লাতাফত এতই বেড়ে যায় যে, তাদের ইনকিশাফাত (দিব্যদৃষ্টি) সাধারণত সঠিকই হয়। হাদীস শরীফে এটাকে ‘বুশরা’ বা সুসংবাদ ও  ‘রু’য়া সালিহাহ’ বা উত্তম স্বপ্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মুকাশাফা, মুরাকাবা ও মুজাহাদা
কোনো কোনো সময় পূর্বোক্ত ইনকিশাফ এতই  উন্নতি লাভ করে যে, এর জন্য ঘুমানোরও কোনো প্রয়োজন হয় না। সাহাবায়ে কিরামের বর্ণনায় কোনো কোনো স্থানে আছে- بين النوم واليقظة ‘ঘুম ও জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি’। এটাকে ‘মুকাশাফা’ বলা হয়। এ কারণে সত্যপন্থি সুফিয়ায়ে কিরামের মধ্যে মুরাকাবার নিয়ম জারি রয়েছে। মুরাকাবা হলো অন্তরকে  দুনিয়া থেকে সরিয়ে এ বিষয়ের অপেক্ষা করা যে, আল্লাহ জাল্লা জালালুহুকে তাঁর দয়ার দৃষ্টিতে দেখে নিবে এবং তাঁর নূর ও তাজাল্লিসমূহের বর্ষণ শুরু হবে। মুরাকাবার জন্য মুজাহাদা জরুরী। মুজাহাদা হলো রিয়াযত করা। রিয়াযত এর অর্থ অহেতুক কষ্ট সহ্য করা নয় বরং সত্যপন্থি, নেককার ও পবিত্র শরীআতের পাবন্দ মুরশিদে কামিলের তা’লীম ও তালকীন অনুযায়ী আমল করার নামই রিয়াযত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন