শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০১৫

সাহাবায়ে কিরামের তাকলীদ

আল্লামা মুফতী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী

সাহাবায়ে কিরামের যুগে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে অভিজ্ঞ, ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের তাকলীদ প্রচলিত ছিল যা মওকুফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তন্মধ্যে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হল।
০১। হযরত উমর (রা.)-এর নির্দেশ:
عَن عكرمةَ عن بن عباس قال خطب عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ خَطَبَ النَّاسَ بِالْجَابِيَةِ فَقَالَ : مَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقُرْآنِ فَلْيَأْتِ أُبَىَّ بْنَ كَعْبٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفَرَائِضِ فَلْيَأَتِ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفِقْهِ فَلْيَأْتِ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْمَالِ فَلْيَأْتِنِى فَإِنَّ اللهَ تَعَالٰى جَعَلَنِى لَهُ والِيًا وَقَاسِمًا.
অর্থাৎ হযরত ইকরামাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাবিয়া নামক স্থানে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এক ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের যে কুরআন (ইলমে কিরাত) সম্পর্কে জানতে চায়, সে যেন হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.)-এর কাছে যায়। ফরাইয সম্পর্কে জানতে চাইলে যেন হযরত যায়দ বিন সাবিত (রা.)-এর কাছে যায়। ফিক্হ সম্পর্কে জানতে চাইলে মুআয বিন জাবাল (রা.)-এর কাছে যায়। আর অর্থ সম্পর্কিত কিছু জানতে চাইলে আমার কাছে আসবে। কারণ আল্লাহ আমাকে সম্পদের ওয়ালী ও বন্টনকারী করেছেন।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায়, যে যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়ে তার তাকলীদ করা যাবে।
২। ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রা.)-এর হাদীস:
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ الرَّجُلِ يَكُونُ لَهُ الدَّيْنُ عَلَى الرَّجُلِ إِلَى أَجَلٍ فَيَضَعُ عَنْهُ صَاحِبُ الْحَقِّ وَيُعَجِّلُهُ الْآخَرُ فَكَرِهَ ذَلِكَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ وَنَهَى عَنْه.
অর্থাৎ হযরত সালিম বিন আব্দুল্লাহ (র.) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণনা করেন- তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে যে অন্য এক জনের কাছে মেয়াদী ঋণে পাওনাদার ছিল। এখন সে মেয়াদের পূর্বে পরিশোধের শর্তে কিছু ছাড় দিতে রাজী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তা অপছন্দ করলেন এবং এরূপ করতে নিষেধ করলেন। (মুসনাদে ইমাম মালিক)
উক্ত হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) নিজের কথার সমর্থনে কোন আয়াত বা মারফু হাদীস উল্লেখ করেননি। সুতরাং বুঝা যায় এটা তার নিজস্ব ইজতিহাদ। আর প্রশ্নকর্তা তাঁর ইজতিহাদী ফতওয়াকে দলীল-প্রমাণ তলব ছাড়াই মেনে নেন।
৩। হযরত সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস (রা.) মসজিদে নামায আদায় করলে রুকু, সিজদা ও সালাত সংক্ষিপ্ত অথচ পরিপূর্ণরূপে করতেন। কিন্তু বাড়িতে নামায আদায় করলে তা দীর্ঘ করে আদায় করতেন। তাঁর ছেলে হযরত মুসআব (রা.) এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন-
يَا بُنَي ، إِنَّا أَئِمَّةٌ يُقْتَدَى بِنَا. (إتحاف الخيرة المهرة ، مُصنف ابن أبي شيبة)
অর্থাৎ হে আমার বৎস! আমরা হলাম ইমাম, আমাদের অনুসরণ করা হয়।
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় হযরত সা’দ (রা.)-এর নামায দীর্ঘ হলে তা দেখে লোকেরা মনে করবে এরূপ করা জরুরী এবং তারা তাঁকে দলীল জিজ্ঞেস না করেই আমল শুরু করে দিবে, যা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
৪। ইহরাম অবস্থায় হযরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.)-এর গায়ে রঙ্গীন কাপড় দেখে হযরত উমর (রা.) তাঁকে এরূপ কাপড় পরিধানের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হযরত তালহা (রা.) জবাব দিলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, এ রং-এ ঘ্রাণ নেই। আর ঘ্রাণ না থাকলে রঙ্গীন কাপড় পরিধান করতে কোন বাঁধা নেই।  জবাবে হযরত উমর (রা.) বলেন-
إِنَّكُمْ أَيُّهَا الرَّهْطُ أَئِمَّةٌ يَقْتَدِى بِكُمُ النَّاسُ فَلَوْ أَنَّ رَجُلاً جَاهِلاً رَأَى هَذَا الثَّوْبَ لَقَالَ : إِنَّ طَلْحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ قَدْ كَانَ يَلْبَسُ الثِّيَابَ الْمُصْبَغَةَ فِى الإِحْرَامِ فَلاَ تَلْبَسُوا أَيُّهَا الرَّهْطُ شَيْئًا مِنْ هَذِهِ الثِّيَابِ الْمُصْبَغَةِ. (موطأ الإمام مالك)
অর্থাৎ আপনারা হলেন ইমাম। লোকজন আপনাদের অনুসরণ করে। যদি কোন অজ্ঞ লোক এ পোশাক দেখে তা হলে বলবে, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.) ইহরাম অবস্থায় রঙ্গীন কাপড় পরিধান করতেন। সুতরাং আপনারা এরূপ রঙ্গীন কাপড় পরিধান করবেন না।
০৫। হযরত আম্মার বিন ইয়াসির ও আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-কে হযরত উমর (রা.) কুফায় প্রেরণ করেন। তাদের সাথে কুফাবাসীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দেন। চিঠির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:
إني قد بعثت إليكم بعمار بن ياسر أميرا وابن مسعود معلما ووزيرا وهما من النجباء من أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم فاقتدوا بهما واسمعوا من قولهما. (تاريخ مدينة دمشق وذكر فضلها)
-আমি তোমাদের কাছে আম্মার বিন ইয়াসির (রা.)-কে আমির এবং আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-কে শিক্ষক ও ওযীর হিসেবে পাঠালাম। তাঁরা দু’জনই হলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশিষ্ট দুই বদরী সাহাবী। সুতরাং তাঁদের ইকতিদা করবে ও যাবতীয় নির্দেশ মেনে চলবে।
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের যুগে তাকলীদ প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল। এমনকি স্বয়ং দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবীকে অনুসরণের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছেন। যদি তাকলীদ বৈধ না হতো তাহলে উমর (রা.) এরূপ ঘোষণা দিতেন না। এমনিভাবে সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর যুগ থেকে তাবিঈ, তাবে তাবিঈনের যুগ ধরে সর্বযুগে তাকলীদ চলে আসছে। সুতরাং তাকলীদ শিরক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না বরং তা জরুরী, বিশেষ করে গায়র মুজতাহিদ আলিমের জন্য তা অপরিহার্য।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু লোক নিজেদেরকে সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী মনে করে বলতে থাকে- শরীআতের মূলনীতি হল কুরআন ও হাদীস। এর বাইরে কোন কিছু মানা যাবে না। তারা কোন ইমামের অনুসরণ বা তাকলীদকে র্শিক বলতে শুরু করলো। তাদের কেউ কেউ আবার সহীহ হাদীস অনুসরণের কথা বলে কেবল বুখারী শরীফে সংকলিত হাদীসের উপর আমল করতেই বেশি আগ্রহী। অথচ বাস্তবে দেখা যায় বুখারী শরীফের অনেক হাদীসের উপরও তাঁদের আমল নেই। ইমাম বুখারী (র.)-এর মতের সাথে তাদের মতামতের কোন মিল নেই। এমনকি পরবর্তী যুগের গায়র মুকল্লিদগণ তাদের পূর্বসূরীদের অনেকের মতামতকে অশালীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেন, অথচ হাদীসের কিতাব বলতে তারা বুঝেন কেবল বুখারী ও কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিম শরীফ। এছাড়া হাদীসের কিতাবকে তারা আমলে আনেন না। তাদের এ আচরণ স্ববিরোধী ও ভ্রান্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
[সূত্র : তাকলীদ-এর সুদৃঢ় রজ্জু]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন