মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০১৫

বিপদ-আপদে আমাদের তাওবাহ-ইসতিগফার করতে হবে


মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের উপমহাদেশে ঘটে যাওয়া ভুমিকম্পে আমাদের পার্শবর্তী দেশ নেপালে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবাণী আমাদের মাতৃভুমিতে কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
ভুমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বিপদ-আপদের কারণ কি? মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ.
-তোমাদের উপর যে বিপদ পতিত হয় না কেন সেটা তোমাদের কৃতকর্মের ফল। তদুপরি তিনি অনেক বিষয় ক্ষমা করে দেন। (আল-কুরআন, সূরা আশ শূরা, আয়াত নং-৩০)
আমাদের নবীর পূর্বে যে সব নবী-রাসূলগণ আগমন করেছেন তাদের উম্মতদেরকে গোনাহ করার সাথে সাথেই শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু আমাদের নবী (সা.)-এর জন্য মহান আল্লাহ আমাদের উপর ইহসান করেছেন। তিনি তার রাসূল (সা.) কে বিশেষ্যত্ব দান করেছেন। যার জন্যে আমরা গোনাহ করার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে গযব দিয়ে ধ্বংস করেন না। মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবীব (সা.) কে উদ্দেশ্য করে ঘোষনা করেন- وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ
(হে নবী) আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দিব না যতক্ষন আপনি পৃথিবীতে থাকবেন। মুফাচ্ছিরীনে কেরাম বলেন- আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে কোন নবীর উপস্থিতিতে তাঁর জাতিকে শাস্তিদেন না। শাস্তি দিতে হলে সে নবীকে সরিয়ে নিয়ে শাস্তি নাযিল করেন। যেমন নূহ (আ.)-এর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি।
উক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশ হলো- وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
-আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যতক্ষণ তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
সুতরাং ভুমিকম্প বা অন্যান্য যে কোন বালা-মসীবতে আমাদেরকে ইসতেগফার করতে হবে। আমাদের গোনাহর জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে।
ইসতেগফার ও যিকিরের অভ্যাস গড়ে তুলা উচিত। কেননা সাধারণত আমরা যখন বিপদের মধ্যে পরি তখন আমদের সবচেয়ে চর্চিত বিষয়গুলো মনে পড়ে। আমার এক হুযুর আমাদেরকে বলেছেন তিনি একবার গাড়ি এক্সিডেন্ট করেন। গাড়ি থেকে নামার পরে এক লোক বললেন-আমি অনেক চেষ্টা করেও কালিমাটা স্মরণ করতে পারিনি।ন্তু আশ্চর্য তিনি মনেই করতে পারেন নি। একই গাড়ীতে এক মহিলা ছিলেন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। স্ট্রেচারে করে তাকে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বেহুশ অবস্থায় পড়তে লাগলেন- حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
মানুষ যখন বেশি পাপ করে তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সতর্ক করার জন্যেও বালা-মসীবত দান করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وما نرسل بالآيات إلا تخويفاً আমি ভয় দেখানোর জন্যই নিদর্শন পাঠিয়ে থাকি।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করে দেন। কিয়ামতের কথা স্মরণ করে দেন।
বিপদের সময় আমাদের করণীয় কি? হাদীস শরীফে এসেছে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- যখন তোমরা বিপদাপদে পতিত হও তখন তোমরা ইসতিগফার করো, দূর্বলদেরকে সহায়তা করো।
فإذا رأيتم ذلك فافزعوا إلى ذكر الله ودعائه واستغفاره.
আমাদের সমাজে যারা খারাপ কাজ করে তাদেরকে বাধা দেওয়া উচিত। কেননা খারাপ কাজের বাধা না দিলে যারা সৎকর্মশীল আছেন তারাও বিপদে পতিত হবেন। তিরমিযী শরীফে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
مثل القائم على حدود الله والمدهن فيه كمثل قوم استهموا على سفينة في البحر فأصاب بعضهم أعلاها وأصاب بعضهم أسفلها فكان الذين في أسفلها يصعدون فيستقون الماء فيصبون على الذين في أعلاها فقال الذين في أعلاها لا ندعم تصعدون فتؤذوننا فقال الذين في أسفلها فإننا ننقبها من أسفلها فنستقي فإن أخذوا على أيديهم فمنعوهم نجوا جميعا وإن تركوهم غرقوا جميعا.
-আল্লাহর বিধান পালনকারী এবং অবহেলাকারীদের মধ্যে দৃষ্ঠান্ত হলো একটি জাহাজের আরোহীদের মতো। যারা লটারীর মাধ্যমে দুই তলায় আসন নিয়েছে। একদল উপর তলায় আর একদল নীচ তলায়। নীচ তলার লোকেরা উপর তলায় আরোহন করত পানি সংগ্রহের জন্য। ফলে দ্বিতীয় তলায় পানি পড়ত। তাই উপর তলার লোকেরা বলল তোমরা আমাদের এখানে পানি ফেলে আমাদের কষ্ঠ দিচ্ছ, সুতরাং আমরা তোমাদেরকে উপরে আরোহন করতে দিব না। নীচের তলার লোকেরা বলল, তবে আমরা জাহাজের তলা ফুটা করে পানির ব্যবস্থা করব। এ অবস্থায় উপরের তলার লোকেরা যদি নীচের তলার লোকদের হাত ঝাপটে ধরে ছিদ্র করা থেকে তাদেরকে বিরত রাখে তবে সকলেই বেঁচে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু যদি এদেরকে এ কাজে বাধা না দেয় তাহলে সকলেই ডুবে যাবে।
আমাদের সকলের উচিত খারাপ কাজ দেখলে বাধা দেওয়া। একটি জাতির উপর যখন আল্লাহর গযব আসলো তখন ফিরিশতারা আল্লাহর কাছে বললেন আল্লাহ! তাদের মধ্যে তো নেককার লোকও আছে। আল্লাহ তাআলা বললেন তাদেরকে সহ ধ্বংস করো, কেননা তারা তাদের দায়িত্ব আদায় করে নি। কারণ তাদের দায়িত্ব ছিল তারা খারাপ লোকদের বাধা দিবে।
বনী ইসরাইল জাতি ধ্বংসের কারণ হিসাবে আল্লাহ তাআলা বলেন
كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ.
তারা যে নিকৃষ্ট কাজ করত তা থেকে একে অপরকে বারণ করত না, তারা যা করত তা অবশ্যই খারাপ।
(আল-কুরআন, সূরা আল মায়িদা:৭৯)
ভুমিকম্প থেকে বাঁচার জন্যে আল্লাহর দরবারে তাওবাহ, ইসতিগফারের পাশাপাশি আমাদের জাগতিক সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা উচিত। এটা দূষণীয় নয়। আল্লাহর উপর ভরসা করব সাথে জাগতিক প্রস্তুতিও রাখব। হাদীস শরীফে আছে এক সাহাবী রাসূল (সা.)-এর দরবারে আসলেন। তিনি রাসূল (সা.) কে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার উট ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করবো না কি বেঁধে আল্লাহর উপর ভরসা করব? রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন أعقلها وتوكلউট বেধে আল্লাহর উপর ভরসা করো। সুতরাং আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করার সাথে সাথে জাগতিক সব ধরনের ব্যবস্থাও রাখব।
...........................
বর্তমান সময়ে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে মানুষ অনেক উচ্চকন্ঠ। কিছুদিন পূর্বেও পাশ্চাত্যে শ্রমিকদের সাথে অমানুষিক আচরণ করা হতো। আন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে। কিন্তু ইসলামের নবী মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) শ্রমকে শ্রদ্ধা করতে, শ্রমিককে তার ন্যায্য অধিকার দিতে স্পষ্ঠ নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ، قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করো।
ইসলামে কষ্টার্জিত উপার্জনকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। হাদীসে এসেছে-
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ
-কারো জন্যে নিজ হাতে উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করতেন।
ইসলাম ভিক্ষা করাকে নিরুৎসাহিত করেছে। নিজে কাজ করে খাওয়াকেই উৎসাহিত করেছে। নামায, রোযা সহ বিভিন্ন ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নিজের জন্যে, নিজের পরিবারের জন্যে হালাল রুযী অর্জন করাও ফরয। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
-তোমরা নামায শেষ করে যমীনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো।
হালাল উপার্জন করা আমাদের সকলের জন্যে আবশ্যক। উপার্জনের মাধ্যম আমাদের সকলের এক হয় না। এখানে আমরা কেউ মালিক আবার কেউ শ্রমিক। আমরা কেউ অফিসের কর্মকর্তা আবার কেউ আমাদের অধীনস্ত। কিন্তু সকলের উদ্দেশ্য এক। হালাল উপার্জন করা। আমাদের অধিনস্ত যারা আছে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি দেখানো উচিত। কেননা তারাও আমাদের ভাই। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
إخوانكم خُوَلُكم، جعلهم الله تحت أيديكم، فلا تُكَلِّفُوهم ما يغلبهم، فإن كَلَّفتموهم فأعينوهم
-তোমাদের অধিনস্তরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধিনস্ত করে দিয়েছেন। তাদের সাধ্যাতীত কাজ তাদের উপর চাপিয়ে দিও না। যদি চাপাতে চাও তাহলে তাদের সাহায্য করো।
এক সাহাবী তার গোলামকে নিয়ে বের হয়েছেন। পথিমধ্যে লোকজন চিনতে পারে নাই মুনিব কে আর গোলাম কে। তারা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন তোমরা কি রাসূল (সা.)-এর হাদীস শুনো নাই? রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরকেও তা পরাবে।
শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দয়া করা আমাদের কর্তব্য। এটা শ্রমিকদের হক। যে কাজ শ্রমিকের জন্য কষ্টকর সে কাজ তাদের দিয়ে করানো একপ্রকার অত্যাচার। তাদের প্রতি দয়া দেখাতে হবে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন الراحمون يرحمهم الرحمن দয়াশীলের প্রতি রহমান (আল্লাহ) দয়া করেন। তিনি আরো বলেন من لا يرحم لا يرحم যে দয়া করে না সে দয়া পায় না। শ্রমিককে তার যথাযথ মজুরী প্রদানে জোর তাকীদ এসেছে। আল্লাহ তাআলা নির্যাতিত শ্রমিকদের পক্ষে থাকেন। হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
ثلاثة أنا خَصمُهم يوم القيامة: رجل أَعطي بي ثم غدر، ورجل باع حرا فأكل ثمنه، ورجل استأجر أجيرا فاستوفى منه ولم يعط أجره
আল্লাহ তা‘আলা ফরমান, আমি কিয়ামতের দিন তিন শ্রেনীর মানুষের বিরুদ্ধে বাদী হবো। প্রথমত এমন লোক যে আমার নামে কাউকে অঙ্গীকার করলো অত;পর গাদ্দারী করলো, দ্বিতীয়ত এমন লোক যে স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করল এবং এর মূল্য খেলো, তৃতীয়ত এমন লোক যে কোন শ্রমিক নিয়োগ করলো আর সেই শ্রমিক যথাযথভাবে তার দায়িত্ব আদায় করলো, কিন্তু তার পারিশ্রমিক আদায় করেনি।
এই তিন শ্রেনীর লোকের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বাদী হবেন।
শ্রমিকদেরও অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। যখন কোন কাজ আদায় করবে তখন যথাযথভাবে আদায় করবে, কাজকে নিজের মনে করে সুন্দরভাবে করবে। হাদীস শরীফে এসেছে-
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يُحِبُّ مِنَ الْعَامِلِ إِذَا عَمِلَ أَنْ يُّحْسِن
সুন্দরভাবে কাজ সম্পাদনকারী শ্রমিককে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন।
শ্রমিকরা নিজেদেরকে নির্যাতিত মনে করলে তারা নিয়মের মধ্যে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে এর প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু রাগ-বিরাগ বা আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের কল-কারখানা, অফিসের ক্ষতি সাধন উচিত নয়।কেননা এটাই তার রিযিক পাওয়ার মাধ্যম। হাদীসে এসছে من رزق في شيئ فليلزمهযাকে কোন মাধ্যমে রিযিক দেওয়া হলো, উচিত হলো সে তা আঁকড়ে থাকবে। অর্থ্যাৎ নিজের উপার্জনের মাধ্যমকে আল্লাহর নি‘আমত মনে করে তার মূল্যায়ন করতে হবে।
আজকে আমরা দুটি বিষয়ে আলাচনা করলাম। প্রথমত বিপদাপদ প্রসঙ্গ। আমরা জানতে পারলাম বিপ; আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। কখনো মানুষের গোনাহের কারণে আবার কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য।
দ্বিতীয়ত আমাদের অধীনস্ত মানুষদের প্রতি সদাচরণ করা ইসলামের নির্দেশ। বিশেষত শ্রমজীবি মানুষের প্রতি আমাদের সদাচরনের জন্য প্রিয়নবী (সা.) জোর তাকীদ প্রদান করেছেন। আল্লাহ উত্তম তৌফিক দাতা।
১.০৫.১৫
[অনুলিখন : মাওলানা মাহমুদুল হাসান]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন