বুধবার, ১১ জুন, ২০১৪

ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ

মুফতি শামসুর রহমান পোরশা

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এর মধ্যে মানবজাতির যাবতীয় কল্যাণ নিহিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত এদুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখবে। একটি হলো, আল্লাহর কালাম কোরআন মাজিদ, অপরটি হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অমূল্য বাণী হাদিস শরীফ। মানব জীবনে সফলকাম হতে হলে, কোরআন-হাদিসে যে সকল বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গ রূপে বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয়ে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে, তা পরিহার করা অতীব জরুরি।
কোরআন-হাদিসে যে সকল বিষয়াবলীর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম একটি হলো, ‘রিবা’ বা সুদ। সুদ শব্দটি আরবি শব্দ ‘রিবা’ থেকে নির্গত। এর অর্থ- অতিরিক্ত, বেশি বা পরিবৃদ্ধি। শরিয়তের পরিভাষায় ‘রিবা’ বা সুদ ঐ অতিরিক্ত সম্পদকে বলা হয়, যা কোনো প্রকার বিনিময় ব্যতীতই অর্জিত হয়। (হিদায়া, হাশিয়া- ৩/৭৭)। এতে ঐ অতিরিক্ত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত, যা ঋণ দিয়ে নেয়া হয়। কেননা ঋণের মধ্যে মূলধন ঠিকই থাকে। আর অতিরিক্ত সম্পদকে কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়াই নেয়া হয়। অনুরূপ বাণিজ্যিক ঔ সকল লেন-দেনও অন্তর্ভূক্ত যা কোনো প্রকার বিনিময় ব্যতীতই অতিরিক্ত হিসাবে নেয়া হয়ে থাকে।
পবিত্র কোরআনে-হাদিসে পরিষ্কার ভাষায় সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সাথে সাথে এর পরিণাম যে ভয়াবহ তাও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বর্ণণা করা হয়েছে। যেমন- অষ্টম হিজরীতে সূরা বাকারার ২৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ পাক সুদকে হারাম ঘোষণা করে বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কবর থেকে কিয়ামত দিবসে দ-ায়মান হবে, যেভাবে দ-ায়মান হয় ঔ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আছর করে মতিচ্ছন্ন করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয়-সুদ নেয়ারই মতো। অথচ আল্লাহপাক ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং যে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তাদের জন্যে জাহান্নাম অবধারিত। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।’ (সূরা বাকারা- ২৭৫)
ইসলামের পূর্বে বর্বরতার যুগে আরবরা সুদকে ক্রয়-বিক্রয়ের মতো মনে করতেন। কারণ তারা মনে করতেন, বেচা-কেনা এবং সুদ উভয়ের মধ্যে লভ্যাংশ উদ্দেশ্য। সুতরাং বেচা-কেনা যেমন হালাল তেমনিভাবে সুদকেই হালাল মনে করতেন। উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহপাক তাদের ধারণকে ভুল সাব্যস্ত করে বলেন, ব্যবসা এবং সুদ এক নয়। এ দুটির মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। তাই সুদকে ব্যবসার মতো মনে করে উভয়কে বৈধ বলা শরীয়ত পরিপন্থী।
তাছাড়া তাদের দাবি যদি মেনে নেয়া হয়, তারপরও সুদ হারাম হওয়ার জন্য এতো টুকু যথেষ্ট যে, এ ভূম-ল ও নভোম-লের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাক ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন। যখন সকল জিনিসের ক্ষমতাধর মহান আল্লাহপাক কোনো বস্তুকে হারাম করেন। তখন এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ থাকে না।
তাছাড়া ব্যবসা এবং সুদ এ দুটিকে এক বা অভিন্ন মনে করা নিতান্ত ভ্রান্তি। কারণ বেচা-কেনা এবং ব্যবসার আসল উদ্দেশ্যর প্রতি লক্ষ্য করলে, ব্যবসা ও সুদের মধ্যে যে অনেক পার্থক্য রয়েছে, তা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যর মধ্যে যে লভ্যাংশ বা অতিরিক্ত সম্পদ অর্জিত হয়, তা পণ্যের বিনিময়ে, আর সুদের মধ্যে পণ্য ব্যতীতই অতিরিক্ত সম্পদ অর্জিত হয়।
তাছাড়া বেচা-কেনা বৈধ হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলো, উভয় পক্ষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তি সম্মতি থাকা। কিন্তু তা সুদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে না। তাই ব্যবসা এবং সুদকে এক মনে করে সুদকেই বৈধ বলা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। এছাড়া কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে সুদের ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে, যেমন- আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গ্রহণ করো না। এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তাতে তোমরা সফলকাম হবে।’ (আল-ইমরান- ১৩০)
সুদকে হারাম ঘোষণা করার সাথে সাথে সুদের বকেয়া অর্থ সর্ম্পকেও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও।’ (সূরা-বাকারা- ২৭৮-২৭৯ )। এ আয়াতে সুদখোরদের কঠিন ধমকি শুনানো হয়েছে, এমন কঠিন ধমকি কুফরী ব্যতীত বড় অপরাধের কারণেও কোনো পাপিষ্ঠদের ওপর কোরআন-হাদিসে আসেনি। এর দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সুদের গুনাহ অত্যন্ত মারাত্মক।
অন্যত্রে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, আমি ইহুদিদের জন্য হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্তু, যা তাদের জন্য হালাল ছিলো। তাদের সীমালংঘনের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক বাধা প্রদানের দরুণ। তার কারণ, তারা সুদ গ্রহণ করতো। অথচ এই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছিলো। (সূরা-নিসা-১৬০-১৬১)। উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সুদ এতোই নিকৃষ্ট যে, তার কারণে হালাল বস্তু পর্যন্ত হারাম করা হয়েছে। ইমাম কুরতুবী (রহ.) উল্লেখ করেন, সুদ এমন নিকৃষ্ট হারাম যা প্রত্যেক শরীয়তে হারাম ছিলো। যেমন- আল্লাহপাক ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বলেন, ইহুদিরা সুদ খায়, অথচ তাওরাতে তাদের জন্য সুদকে হারাম করা হয়েছিলো। (তাফসীরে কোরতুবী-৩/৩৬৬)। অন্রুূপভাবে অন্যান্য আসমানী কিতাবসূমহে সুদের ওপর নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছিলো। যে বস্তুকে প্রত্যেক শরীয়তে হারাম করা হয়েছে, তা কি পরিমাণ অপছন্দনীয় ও জঘন্য হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
সুদ হারাম হওয়া সর্ম্পকে এ হাদিসটিই ছিলো সর্বশেষ ঘোষণা। হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) উল্লেখ করেন, সুদ হারাম হওয়ার বিধানটি ইসলামের বিধান সূমহের মধ্যে সর্বশেষ বিধান। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের লিখক এবং সুদী লেন-দেনের সাক্ষী দ্বয়ের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, তারা গুনাহের ব্যাপারে সকলেই সমান অপরাধী।’ (মুসলিম শরীফ- ২/২৭)। অন্যত্রে হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সুদের মধ্যে সত্তর প্রকার গুনাহ বিদ্যমান রয়েছে। এর সবচেয়ে নিম্নস্তরের গুনাহটি হলো, নিজের মায়ের সাথে যিনা করার সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ পৃ- ১৬৪)
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদ খাওয়াকে কবিরা গুনাহের অন্তভুর্ক্ত করে বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বাংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! সে সাতটি জিনিস কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, এক. আল্লাহ তা‘আল্লার সাথে কাউকে অংশীদার করা। দুই. যাদু বিদ্যা অর্জন করা। তিন. অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করা। চার. সুদ ভক্ষণ করা। পঞ্চম. ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা। ছয়. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা। সাত. কোনো নিরঅপরাধী নারীকে অপবাদ দেয়া।’ (মুসলিম শরীফ-১/৬৪)। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহপাক চার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না এবং তাদেরকে জান্নাতের নিয়ামত সমূহ থেকে বঞ্চিত করবেন। তারা হলেন, এক. মদপান কারী। দুই. সুদ ভক্ষণ কারী। তিন. অন্যায় ভাবে ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারী। চার. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।’ (হাকিম) তাছাড়া সুদের একটি কুবৈশিষ্ট্য রয়েছে। যে ব্যক্তি সুদী লেন-দেনে অভ্যস্ত, সম্পদের লোভ-লালসা তাকে এমন বিবেকহীন ও উদাসীন করে যে, সারাক্ষণ কিভাবে সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, সে চিন্তায় মগ্ন থাকে। অথচ সুদের মাধ্যমে যে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাতে বরকত থাকে না। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুদের মাধ্যমে সম্পদ বাড়ায়, তার সম্পদে অবশ্যই ঘাটতি দেখা দিবে।’ (ইবনে মাজাহ পৃ- ১৬৫) বর্তমান যুগে সুদ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কোরআন-হাদিসের এর নিষেধাজ্ঞা ও এর ভয়াবহ শাস্তির দিকে অনেকেই কর্ণপাত করছেন না। অনেকেই আবার সুদকে অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ মনে করছেন এবং আবার অনেকেই সুদকে দারিদ্র্যতা বিমোচনের অন্যতম পন্থা হিসাবে আখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, সুদ কখনো কোনো গরিবের দারিদ্র্যতা বিমোচন করতে সক্ষম হয়নি, বরং সুদ গরীবকে আরো গরীব এবং ধনীকে আরো ধনী বানিয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে কিছু কিছু ব্যক্তি সুদের সাময়িক উপকার দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। অথচ সুদের জাগতিক ও পারলৌকিকের ভয়াভয় পরিণাম এ উপকারের তুলনায় যে অত্যন্ত জঘন্য, সে দিকে লক্ষ্য রাখেন না। আল্লাহপাক সকলকে সুদের ভয়াবহতা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন