বুধবার, ১১ জুন, ২০১৪

শবে বরাত বিতর্ক


Posted by Shawon Muhammad Shahriar

বছর পাচেক আগের কথা। চাকরির সুবাদে তখন আমি খুলনাতে থাকতাম। একই ফ্ল্যাটে আমার সঙ্গে থাকতেন আমারই বয়সী আরো দুইজন ভদ্রলোক। সেদিন ছিল শবে বরাতের রাত। মসজিদের লাউড স্পিকারগুলো থেকে ভেসে আসছে ওয়াজ, যিকর আর দুআর আওয়াজ। আশে-পাশের বাসা থেকে ভেসে আসছে মুখে জল আনা সব খাবারের গন্ধ। বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ গেছেন মসজিদে। মহিলারা ব্যস্ত খাবার তৈরি আর পরিবেশনে, একটু পরে তারাও শুরু করবেন নফল ইবাদাত।

রাত সাড়ে নয়টা বাজতে তখন কয়েক মিনিট বাকী। আমার এক ফ্ল্যাটমেটকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন শবে বরাত বলে আদৌ কিছু আছে কি না। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বক্তাদের বিপরীতধর্মী কথাবার্তায় অন্যদের মতো উনিও খানিকটা কনফিউসড। আমি খুব কনফিডেন্স নিয়ে তাকে বলে দিলাম যে শবে বরাত বলে আসলে কিছু নেই, তাই এই রাতের বিশেষ কোন তাৎপর্যও নেই।

সর্বনাশ! যেই না বলা অমনি উনি সনি এন্টারটেইনমেন্ট টিভিতে টিউন করলেন। একটু পরেই যে শুরু হবে সুপার হিট শো ইন্ডিয়ান আইডল। পরবর্তী ঘন্টাখানাকের জন্য আমার ফ্ল্যাটমেট ডুবে গেলেন হিন্দি গানের জগতে। তখন নিজেকে কিছুটা হলেও দোষী মনে হতে লাগল। যদি আমি তাকে বলতাম যে শবে বরাত একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাত তবে হয়ত উনি কিছু ইবাদাত-বন্দেগি করতেন, হয়ত উনি ওই রাতে ইন্ডিয়ান আইডল দেখতেন না। হোক এক রাতের জন্য, তবুও তো আল্লাহকে কিছুটা স্মরণ করতেন!

ওই সময়ে আমি একটি বিশেষ দেশের উলামা এবং তাদের অনুসারীদের লেখা বেশি পড়তাম এবং তাদের মতকেই একমাত্র “সঠিক ইসলাম” বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম। বিতর্ক এড়ানোর জন্য সঙ্গত কারণেই দেশটির নাম উল্লেখ করছি না।

পরবর্তীতে অন্যান্য দেশের উলামা এবং তাদের অনুসারীদের লেখার সঙ্গেও ধীরে ধীরে পরিচিত হতে শুরু করলাম। যতই পড়তে থাকলাম ততই আবিষ্কার করতে থাকলাম যে “সঠিক ইসলাম” বিশেষ কোন দেশের উলামাদের একক সম্পত্তি নয়। একই বিষয়ে একাধিক মতামত থাকতে পারে, আর মজার বিষয় হল এগুলোর কোনটিই ভুল নাও হতে পারে। ফলে উলামাদের কোন মতকেই সরাসরি ভুল বলে উড়িয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না।

শবে বরাত এমন একটি বিষয় যা নিয়ে অনেক আগে থেকেই উলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। এখানে ইচ্ছা করেই আমি শবে বরাত সংশ্লিষ্ট হাদিসসমূহের বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করছি না, কারণ না আমি নিজে, না এই লেখার পাঠকরা উসুল আল-হাদিস এবং রিজালশাস্ত্র নিয়ে তেমন কোন বিশেষ জ্ঞান রাখেন। জৈব রসায়নের কোন বিশেষ সূত্র নিয়ে আলোচনার সঠিক জায়গা যেমন এটি নয়, তেমনি কোন বিশেষ হাদিসের বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা নিয়ে সমালোচনামূলক বিস্তারিত আলোচনার সঠিক জায়গাও এটি নয়। সাধারণ মানুষ হিসেবে তাই এই বিষয়ে উলামাদের মত জানাটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

যেসব বিখ্যাত উলামা শবে বরাতের বিশেষ তাৎপর্যের পক্ষে মত দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ইমাম আওযায়ী, ইমাম ইবন তায়মিয়্যা, ইমাম ইবন রজব এবং তৎকালীন শামদেশীয় অধিকাংশ উলামা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম)। অন্যদিকে ইমাম আতা বিন আবি রাবাহ, ইবন আবি মুলাইকা, ইমাম মালিকের ছাত্রগণ এবং তৎকালীন হিজাজের অধিকাংশ উলামাদের (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম) মতে শবে বরাতের বিশেষ কোন তাৎপর্য নেই, বরং এই রাতটি অন্যান্য রাতগুলোর মতোই।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, শবে বরাত বিষয়টি সাদা-কালো বা দিন-রাতের মতো কোন স্পষ্ট বিষয় নয়, বরং এটি এমন একটি বিষয় যেটি নিয়ে যুগের পর যুগ ঘরে মতপার্থক্য চলে আসছে। তাই আপনি শবে বরাত পালন করুন বা না করুন, অন্ততপক্ষে আপনার বিপরীত মতের অনুসারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এটিই কাম্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ধর্মীয় বিবাদপূর্ণ বিষয়সমূহে আমাদের আরো সহনশীল হওয়ার তৌফিক দিন এই কামনা করি।

http://hridoyeislamdotcom.wordpress.com/2012/07/05/shab-e-barat-debate/#

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন