বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৩

আমাদের জীবনের চাহিদা ও রাসূলে পাক (সা.)-এর একটি হাদীস

 মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে নানা রকম নিয়ামতে অনুগৃহীত করেছেন। সারা পৃথিবী, পৃথিবীর আলো, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, মাটি, পানি, রোদ, বৃষ্টি, শস্য, ফল-ফলাদি, শাক সবজি এককথায় সৃষ্টিজগতের সবকিছুকেই মহান আল্লাহ আমাদের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর নিয়ামত গণনা করে আমরা কখনো শেষ করতে পারব না। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন- যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতকে গণনা কর তবে তোমরা তা গণনা করতে পারবে না। (সূরা ঃ আন নাহল, আয়াত ঃ ১৮)
আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের দেয়া অসংখ্য-অগণিত নিয়ামতরাজি স্বত্ত্বেও দুনিয়ার জীবনে আমরা আরো চাই। আমাদের চাওয়ার কোন শেষ হয় না। আমাদের এক চাহিদা পূরণ হলে নতুন করে আরেক চাহিদা সৃষ্টি হয়। গৃহহীন হলে আমরা গৃহ চাই। তারপর সুন্দর একটা বাড়ী চাই। এরপর চাই আরো কত কী। আমরা জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব চাই, মান-সম্মানে সবার শীর্ষে অবস্থান চাই, সবার চেয়ে ধনী হতে চাই, বিশিষ্ট সমাজসেবী হতে চাই, সমাজে সালিশ-বিচারে গ্রহণযোগ্য মানুষ হতে চাই, শুধু চাই আর চাই। এ সকল চাওয়া কিভাবে পূর্ণ হতে পারে? এ বিষয়ে একটি হাদীসে আমাদের জন্য রয়েছে সুমহান শিক্ষা। একজন সাহাবী ইহ-পরকালের নানা চাহিদার বিষয়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করেছিলেন। এর জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সুন্দর দিকনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতী (র.) কৃত ‘জামিউল আহাদীস’ গ্রন্থে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর সনদে বর্ণিত হাদীসটি নি¤œরূপ ঃ
এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বলল ঃ (ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.) আমি আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাতের কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করতে চাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তোমার যা খুশী প্রশ্ন কর।
তখন লোকটি বলল ঃ হে আল্লাহর নবী! আমি সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তুমি সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হবে।
লোকটি বলল ঃ আমি সবচেয়ে ধনী মানুষ হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ অল্পে তুষ্ট হও, তাহলে তুমি সবচেয়ে ধনী মানুষ হবে।
লোকটি বলল ঃ আমি সর্বোত্তম মানুষ হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ সর্বোত্তম মানুষ সেই যে মানুষের উপকার করে। সূতরাং তুমি মানুষের উপকারকারী হও।
লোকটি বলল ঃ আমি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ কর অন্যের জন্য তা পছন্দ করবে তাহলে তুমি তুমি সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ মানুষ হবে।
লোকটি বলল ঃ আমি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে খাস মানুষ হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ বেশী করে আল্লাহর যিক্্র কর তাহলে তুমি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে খাস বান্দা হতে পারবে।
লোকটি বলল ঃ আমি নেককার মানুষদের অন্তর্ভূক্ত হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পার (অর্থাৎ তাকে দেখছ এই অনুভূতি জাগ্রত করতে না পার) তাহলে মনে কর (এই অনুভূতি রাখ) যে তিনি তোমাকে দেখছেন।
লোকটি বলল ঃ আমি চাই যেন আমার ঈমান পরিপূর্ণ হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি তোমার চরিত্রকে সুন্দর কর তাহলে তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হবে।
লোকটি বলল ঃ আমি আল্লাহর অনুগত বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ আল্লাহর নির্ধারিত ফরযসমূহকে আদায় কর তাহলে তুমি অনুগতদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
লোকটি বলল ঃ আমি গুনাহ থেকে পাক-পবিত্র হয়ে আল্লাহর সাথে স্বাক্ষাত করতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ অপবিত্রতা থেকে ভালভাবে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে গোসল করবে তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এমনভাবে স্বাক্ষাতভাবে করবে যেন তোমার কোন গুনাই নেই।
লোকটি বলল ঃ আমি চাই কিয়ামতের দিন যেন নূরের মধ্যে আমার হাশর হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি কারো প্রতি যুলুম করবে না তাহলে কিয়ামতের দিন নূরের মধ্যে তোমার হাশর হবে।
লোকটি বলল ঃ আমি চাই যেন আমার রব আমার প্রতি দয়া করেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি তোমার নিজের প্রতি এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া কর তাহলে আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন।
লোকটি বলল ঃ আমি আমার গুনাহকে কমাতে চাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও (ইস্তিগফার কর) তাহলে তোমার গুনাহ কমে যাবে।
উক্ত হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা নানা চাহিদা কিভাবে পূরণ হতে পারে তার একটি সুন্দর ছক এঁকে দিয়েছেন। হাদীসটিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব অর্জনের লক্ষে বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন ঃ
ক. তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্জন করা।
খ. অল্পে তুষ্ট থাকা।
গ. পরোপকার করা।
ঘ. নিজের জন্য যা চাইবে অন্যের জন্য তা চাওয়া।
ঙ. বেশী করে আল্লাহর যিক্্র করা।
চ. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা।
ছ. চরিত্রকে সুন্দর করা।
জ. ফরয ইবাদাতসমূহ পালন করা।
ঝ. উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করা।
ঞ. কারো প্রতি যুলুম না করা।
ট. সৃষ্টির সেবা করা।
ঠ. তাওবা-ইস্তিগফার করা।
যদি আমরা এ সব বিষয় নিজের জীবনে যথাযথ ও খালিসভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে অবশ্যই সকল ক্ষেত্রে আমরা শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হতে পারব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন